নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
নানান জাতের উদ্ভিদের মাঝে এখনো প্রকৃতিতে টিকে আছে আদি উদ্ভিদ শিমুল গাছ। আধুনিক যুগের বাসা বাড়ীতে আসবাবপত্র তৈরি করতে শিমুল গাছের কাঠের প্রয়োজন না হলেও বাংলার ঘরে ঘরে এখনো শিমুলের তুলার যথেষ্ট কদর রয়েছে। আগের দিনের মত আবহাওয়া অনুকুলে না থাকায় গাছে পর্যাপ্ত পরিমান ফুল আসার পরেও তুলার ফলন ভাল না হওয়ায় শিমুল গাছের তুলা ব্যবহার করা থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
তবে শিমুল তুলা অত্যান্ত নরম ও মোলায়েম হওয়ার কারণে গ্রামগঞ্জে এখনো শিমুল তুলার তৈরি লেপ, তোষক ও বালিশ শোভা পাচ্ছে। বন ও পরিবেশবীদদের মতে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বিদেশ থেকে নানা জাতের বনজবৃক্ষের চারা এদেশে নিয়ে আসার পর থেকে অন্যান্য বনজ ও ফলজ বৃক্ষের মাঝ থেকে শিমুল গাছের সংখ্যা কমে গিয়ে একের তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে। আগের দিনে লোকজন এই শিমুল গাছের কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করা ছাড়াও দেয়াশলাইয়ের কাঠি তৈরিতে শিমুল কাঠ ছিল অতুলনীয়। অথচ বর্তমানে উন্নতমানের বনজ কাঠের কাছে শিমুল গাছ হার মেনে বিলুপ্ত হতে চলেছে। সেই সাথে শিমুলের তুলার চাহিদাও অনেকটা কমে গেছে। শুধু তাই নয়, যেখানে বাংলার মাঠে ঘাটে বনজ ও ফলজ বৃক্ষে ভরে গেছে, সেখানে শুধু মাত্র তুলা সংগ্রহের জন্য শিমুল গাছ রোপন করার সময় এবং মানুসিকতা কারোরই এখন নেই। কিন্তু এক সময় এই শিমুল তুলার তৈরি তোষক ও নরম বালিশ ছাড়া অনেকের আরামের ঘুম হত না।
রবিবার ২০ এপ্রিল এ প্রসঙ্গে উপজেলার কালুপাড়া ইউনিয়নের কালা আমের তল গ্রামের তুলা সংগ্রহকারী আনোয়ার হোসেন (৫৪) সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এখন বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় উন্নত জাতের বাঙ্গার তুলার চাষ হচ্ছে। তাই শিমুল তুলার কদর একেবারেই কমে গেছে। তুলা ব্যবসায়ীদের কাছে শিমুল তুলা চার শত টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও আমাদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা কিনছে মাত্র ২শ টাকা দরে। গাছ থেকে এক কেজি তুলা সংগ্রহ করতে কতটা কষ্ট করতে হয় তা কেউ বুঝলে আমরা বুঝি। একই এলাকার রহমত আল (৪৬) ও জামান মিয়া (৪৯) আক্ষেপ করে বলেন, প্রতি বছর এই সময় বদরগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে শিমুল গাছ মালিকদের সাথে যোগাযোগ করে চুক্তি ভিত্তিক তুলা সংগ্রহ করে থাকি। এতে করে তুলার যা অংশ পাই তা গড়ে বছরে ১০/১২মন পর্যন্ত হয়। কিন্তু আগের মত এই তুলার দাম না থাকায় তুলা সংগ্রহ করার কাজ ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। এছাড়াও জীবন বাজী রেখে শিমুল গাছের মগডালে উঠে তুলার সংগ্রহ করতে মন চায়না। কারণ শিমুল গাছের ডালপালা খুব নরম তাই সহজে ভেঙ্গে যায়। তবুও জীবিকার তাগিদে আমরা এসব কাজ করছি।
এ ব্যাপারে উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের পাটোয়ারি পাড়া গ্রামের আব্দুল মতিন (৬৭) বলেন, এক যুগ আগে আমাদের জমির (ভিটা মাটি) ধারে বেশ কয়েকটি শিমুল গাছ ছিল। প্রতি বছর গাছ থেকে তুলা সংগ্রহ করতাম। বর্তমানে ওই স্থানে ফলজ গাছপালা রোপন করার কারণে শিমুল গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। আধুনিক যুগে যেখানে হাতের কাছে নানান প্রকার ফোম ও তুলা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে শিমুল তুলা সংগ্রহ করার সময় কোথায়? লোহানীপাড়া ইউনিয়নের কাঁচাবাড়ী গ্রামের আজমল হোসেন (৫২) বলেন, বাড়ীর পার্শ্বে এখনো কয়েকটি মাঝারী আকারের শিমুল গাছ রয়েছে। গাছ গুলোতে প্রতি বছর ফুল ও ফল আসে। অথচ, তুলা সংগ্রহ করার অবহেলায় গাছ থেকে তুলা ঝরে পড়ে যায়। বলা যায় এই যুগের মানুষ শিমুলের তুলার ব্যবহার ভুলতে বসেছে।
শিমুল গাছ সাধারণ ৭০-৮০ হাত লম্বা ও ৬-৭ হাত বা এর চেয়েও মোটা আকারের হয়ে থাকে। বন্যার পানি বা খরায় এর কোনো ক্ষতি হয় না। বাঁচেও শতাব্দির পর শতাব্দি কাল পর্যন্ত। মাঘ ফাল্গুন মাসে এ গাছে ফুল ধরে এবং চৈত্র বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ফল পরিপক্ব হয়। এগুলো সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে নিলে এর ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে সাদা ধবধবে তুলা। একটি বড় আকারের শিমুল গাছ থেকে বছরে কমপক্ষে ৩-৪ মণ এমনকি তারও বেশি তুলা পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রতিকেজি শিমুল তুলা ৪০০ টাকা হিসেবে যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৪৮ হাজার থেকে ৬৪ হাজার টাকা।
এক বিঘা পরিমাণ পতিত জমিতে লাইন করে প্রায় ৩০টি শিমুল গাছ লাগানো যেতে পারে। এর সবগুলোতে ফল দেয়া শুরু করলে তা থেকে তুলা সংগ্রহ করে বিক্রি করলে বছরে প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা হতে পারে। বদরগঞ্জ ও তার আশেপাশে বেশকিছু পরিবার রয়েছে শিমুলের সংগৃহীত তুলা বিক্রি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালান।
এ ছাড়া শিমুল গাছ বড় আকারের হওয়ায় এর নিচে শাক-সবজি, মরিচ, বেগুন, পেঁয়াজ-রসুন, হলুদ ইত্যাদি আবাদ করায়ও কোনো অসুবিধা হয় না। তবে এ অঞ্চলের এক শ্রেণির অলস প্রকৃতির লোকজনের অবহেলার দরুণ শিমুল গাছ থেকে যথাসময়ে ফল সংগ্রহ না করার কারণে বিপুল মূল্যের তুলা গাছে থাকা অবস্থায়ই আকাশে উড়ে যায়।
শিমুল তুলা যে শুধু মাথায় দেয়া লেপ,তোষক,বালিশের কাজে ব্যবহৃত হয় তাই নয়-শিমুল গাছের ছালও বিষফোঁড়া নিরাময়ের মহৌষধ। কবিরাজগণ পুরনো শিমুল গাছের ছাল চূর্ণ করে তাতে পুরনো গাওয়া ঘি মিশ্রিত করে বিষফোঁড়ার ওপর প্রলেপ দিয়ে থাকে। তাছাড়া শিমুল মুলের কুচি কুচি চূর্ণ রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে গুড়সহ খালি পেটে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় হয়। এমনকি বলবর্দ্ধকও বটে-মন্তব্য কবিরাজগণের।
শিমুলের কচি কাঠ দিয়াশলাইয়ের কাঠি তৈরিতে উৎকৃষ্ট উপাদান হিসেবে বিবেচিত। শিমুলের পাতাও উৎকৃষ্ট জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিমুল তুলার বীজ থেকে কোনো ভোজ্য তেল তৈরি সম্ভব কিনা তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দাবি রাখে।
শিমুল গাছ গ্রামবাংলার মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।সারিবদ্ধভাবে বা বিক্ষিপ্তভাবে কাঁটাযুক্ত শিমুল গাছ গ্রামবাংলার সর্বত্রই কমবেশি নজরে পড়ে। তবে লালচে তাম্র বর্ণের মাটিতে টিলা আকারের স্থানে শিমুল গাছ বেশি জন্মে থাকে। বীজ থেকে চারা ফুটে বের হবার পর থেকে ৭-৮ বছরের মধ্যেই শিমুল গাছে ফুল ফোটে ও ফল ধরে। তবে গাছের বয়োপ্রাপ্তি হয় ১০-১২ বছর পর। এ সময় থেকেই শিমুল গাছ থেকে অর্থনৈতিক উপযোগিতা পাওয়া যায়।