অপার সৌন্দর্যের ইতিহাস- ঐতিহ্যের নোয়াখালীর সেনবাগের জমিদারবাড়ি হতে পারে পর্যটনের অপার সম্ভবনা

নবজাগরণ রিপোর্ট : জেলার সেনবাগ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের কল্যান্দী জমিদার বাড়িটি স্থানীয়দের কাছে রায় চৌধুরী জমিদার বাড়ি হিসেবে ও বেশ পরিচিত। এই বাড়িটি দুই জমিদার মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন। জমিদার রামেন্দ্র রায় চৌধুরী ও জমিদার কাঙালি রায় চৌধুরী ১৮০০ শতকের দিকে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন।

তারা প্রজাদের কল্যাণে অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করে গেছেন। জমিদার রামেন্দ্র রায় চৌধুরী তার নামানুসারে নোয়াখালী জেলায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার এইরকম বিভিন্ন ধরনের সাহসী উদ্যোগের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে রায় বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন। এই জমিদারদের অধীনে মোট ১৯টি তালুক ছিল। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে জমিদার বংশের অনেকেই ভারতে চলে যান। এখনও জমিদার বংশের কয়েকজন এখানে বসবাস করতেছেন।

রামেন্দ্র রায় চৌধুরী ও কাঙালি রায় চৌধুরী প্রজা শাসনের পাশাপাশি জনকল্যাণ শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও ধর্ম পালনের জন্য একে একে প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদপুর রামেন্দ্র মডেল হাই স্কুল, কল্যান্দী হরিহর চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি, কল্যান্দী হরি মন্দির, দোল মন্দির, তুলসী মন্দির, নাট মন্দির, হিন্দু মিলন মন্দির, কল্যান্দি সর্বজনীন পূজা মন্দির, শাহাজীর হাট, শাহাজীরহাট মসজিদ, কল্যান্দি বাজার, বৈরাগির হাট নোয়াখালী পুরাতন শহরে রামেন্দ্র প্রেস, দাগনভূঁইয়ার বোলগাঁও চন্দ্র মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তারা। ছমির মুন্সীর হাটে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা এবং একটি বাজার সহ ৩.৭০ একর দান করেন। এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সুনাম অর্জন করায় ব্রিটিশ সরকার তাঁদেরকে রায় বাহাদুর উপাধি দিয়েছিলেন।

১৯৫১/৫২সালের দিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত শেষের দিকে ও তারা এলাকায় ছিলেন প্রচণ্ড প্রতাবশালী।জমিদারের বংশধরদের অনেকেই মারা গেছে আবার অনেকে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে স্থায়ীভাবে বাস করছে।
কল্যান্দি জমিদারের বংশধর দ্বীনেশ রায় চৌধুরী (৮৭) তাঁর ভাই পুলেকশ্বর রায় চৌধুরী (৭০) স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন দ্বীনেশ রায় চৌধুরীর দুই সন্তান তমাল রায় চৌধুরী, মেয়ে দিপু রায় চৌধুরী এবং পুলেকশ্বরায় চৌধুরীর স্ত্রী চিত্রা রায় চৌধুরীর ছেলে রাতুল রায় চৌধুরী।

রাম নারায়ন চৌধুরীর ছিলো দুই ছেলে রামেন্দ্র রায় চৌধুরী ও কাঙ্গালী রায় চৌধুরী। এদিকে কাঙ্গালী রায় চৌধুরীর ছিলো একমাত্র ছেলে কৃঞ্চ কুমার রায় চৌধুরী। কৃঞ্চ কুমার রায় চৌধুরীর তিন ছেলে হেম চন্দ্র রায় চৌধুরী, হরেন্দ্র রায় চৌধুরী, ও হরিহর রায় চৌধুরী।
অপরদিকে রামেন্দ্র রায় চৌধুরীর রায় চৌধুরীর ছিলা তিন ছেলে হরি প্রশন্ন রায় চৌধুরী, কৃঞ্চ প্রশন্ন রায় চৌধুরী ও কালী প্রশন্ন রায় চৌধুরী। এ দিকে হরি প্রশন্ন ও কালী প্রশন্ন ছিলো নিঃসন্তান। এদের মধ্যে কৃঞ্চ প্রশন্ন রায় চৌধুরীর ছিলো ৭ ছেলে তিন মেয়ে তারা হচ্ছে: নরেশ রায় চৌধুরী,সুরেশ রায় চৌধুরী,দ্বিনেশ রায় চৌধুরী, অরুণ রায় চৌধুরী, কুমারেশ্বর রায় চৌধুরী, পুলেকেশ্বর রায় চৌধুরী ,মেয়ে দিপ্ত কনা চৌধুরী, সিন্ধু রায় চৌধুরী ও স্বপ্না রায় চৌধুরী।

এদের মধ্যে নরেশ,সুরেশ,অরুন,রামেন্দ্র, দিপ্ত মারা গেছে। এদের রামেন্দ্র রায় চৌধুরীর ছেলে দ্বীনেশ রায় চৌধুরী ,স্ত্রী চিত্রা রায় চৌধুরী, ছেলে তমাল রায় চৌধুরী, মেয়ে দিপু রায় চৌধুরীকে নিয়ে ও পুলেকেশ্বর রায় চৌধুরী তার স্ত্রী রত্না রায় চৌধুরী ছেলে রাতুল রায় চৌধুরীকে নিয়ে বর্তমানে এই বাড়িতে বসবাস করছেন। এছাড়া তাদের অপর ভাই কুমারেশ্বর রায় চৌধুরী ভারতে অবস্থান করছে।

জমিদার রামেন্দ্র রায় চৌধুরীর বংশধর দ্বিনেশ রায় চৌধুরী জানান, একসময় তাদের প্রায় ২০ এর অধিক জায়গার ওপর তাদের সুরম্য অট্টালিকা ছিল, এখন তারা যে বাড়িতে বসবাস করে সেটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তৈরি। এই বাড়িতে একটি কাছারি ঘর, দুটি দুইতলা থাকার ঘর আছে। এই কাছারি ঘরটিতে এখন আর বসবাসের অবস্থা নাই। একসময় দূরদুরান্ত থেকে বিভিন্ন জমিদার এবং উচ্চবর্গীয় ব্যক্তিবর্গ এখানে আসতেন থাকতেন। কালের বিবর্তনে আজ তা সবই স্মৃতি।

জমিদার বাড়িটি লোহা,কাঠ ও ইট-চুন দিয়ে দো-তলা সুরুর্ম দুইটি বসতঘর নির্মান করা হয়েছিলো। বর্তমানে ভবন দুটির অধিকাংশ স্থানে ফাটল ধরে ইট-চুন সুরকী খুলে পড়েছে। ভবন দুইটিতে আগাছা পরগাছা জন্মনিয়ে বেহাল দশা হয়ে পড়েছে।

তাদের পূর্ব পুরুষরা কাঙ্গালী কাঙ্গারী রায় চৌধুরীর নাতী হরিহর রায় চৌধুরী আত্মহত্যা করে মারাগেলে তার আত্মার শান্তি কামনায় তার নামে এলাকার অসহায়, দুঃস্থদের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো কল্যান্দী হরিহর চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি যার কার্যক্রম চলমান ছিলো ১৯৯০-৯১ সাল পর্যন্ত। একটি ঝড়ে ডিসপেনসারির ভবনের ছাল ক্ষতিগ্রস্থ হলে তার সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

জনহিতকর কাজের পাশাপাশি প্রজাদের ওপর অকারণে নানান রকমের অত্যাচার ও তারা চালাতে দ্বিধা করতো না। এছাড়া সাধারণ প্রজাদেরকে তারা মানুষই মনে করতেননা বলে মুরুব্বিদের মুখে শোনা যায়। তাদের অবাধ্য হলে তার ওপর চালাতো নিষ্ঠুর নির্যাতন। খাজনা দিতে দেরি হলে বসত বিটা সহ সকল জায়গা নিলামে দিত। প্রজাদের ফসিল জমি হাতি দিয়ে নষ্ট করতো, বাড়ির দরজা দিয়ে জুতা পায়ে দিয়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে কোন লোক যেতে পারতেন না। তাদের নিষ্ঠুরতা নিয়ে ও লোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া যায় এলাকার প্রবীণ মানুষদের কাছে।

বর্তমানে এ জমিদার বাড়িটি কালের স্বাক্ষী হয়ে তার স্মৃতি বহন করছে।।।
অপার সৌন্দর্যের ইতিহাস- ঐতিহ্যের সেনবাগের জমিদারবাড়ি হতে পারে পর্যটনের অপার সম্ভবনা।সরকারি উদ্যোগে স্থাপনাগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সুরক্ষার মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে উম্মুক্ত করা হলে ব্যাপক দর্শনার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় জনসাধারণ।