মো: আবু তাহের পাটোয়ারী।।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ভারতীয় সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করলেও সেই সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একপাক্ষিক ও অনিয়মিত হয়ে উঠেছে। আজ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে ভারতের রাজনৈতিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুবিধা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুত্বের নামে ভারতের যে আগ্রাসী নীতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে আমাদের সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা ও জনগণের অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত। এটি নিছক পড়শি সম্পর্ক নয়;এ এক অঘোষিত আধিপত্যবাদ।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে আসছে। যেসব সরকার ভারতের প্রতি ‘নমনীয়’ থেকেছে, তাদের প্রতি ভারতের আনুগত্য বরাবরই বেশি দেখা গেছে। অন্যদিকে যারা জাতীয় স্বার্থে নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছে, তাদের বিরুদ্ধে ভারতের মিডিয়া, গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি রাজনৈতিক মহলেও বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতার অভিযোগ—ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চায়, বিশেষ করে কাকে ক্ষমতায় আনবে তা নির্ধারণে দিল্লির দিকনির্দেশনা অপেক্ষাকৃত বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে।
সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতিবছরই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (BSF) কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা ঘটে। এর কোনো আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা নেই। ভারতের অভ্যন্তরে যেভাবে একটি জীবন মূল্যবান, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে সেই মূল্য নেই। প্রতিবাদ করলেও ফলাফল শূন্য। একটি প্রতিবেশী “বন্ধু রাষ্ট্র” এমন নৃশংস আচরণ কীভাবে চালাতে পারে, তা একটি মৌলিক প্রশ্ন।
পানি সমস্যা ও একতরফা নদীশাসন নীতি:
ভারত একতরফাভাবে গঙ্গা, তিস্তা ও অন্যান্য অভিন্ন নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, যার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের জীবনে পড়ে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে এক দশকের বেশি সময় ধরে ভারত সময়ক্ষেপণ করে যাচ্ছে, অথচ ফারাক্কা ব্যারাজসহ একাধিক স্থাপনা দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে কার্যত মরুভূমিতে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পানির ওপর ভারতের এই আধিপত্য প্রমাণ করে যে, তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নয়।
অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও একমুখী বাণিজ্য
ভারত বাংলাদেশের বাজারকে ব্যবহার করছে তাদের পণ্যের জন্য। প্রতি বছর বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি বহন করে। বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বাজারে ঢুকতে দেয় না, অথচ ভারতীয় পণ্য কর-ছাড়ে বাংলাদেশে ঢোকে। ভারতীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য, কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের ভারতে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব।
ভারতীয় মিডিয়ার অপমানজনক প্রচার!
ভারতের কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বারবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি নিয়ে এমনভাবে কথা বলে যা উপনিবেশিক ঔদ্ধত্যের প্রতিফলন। বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে নয়, তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চায়, যা দুটি সার্বভৌম দেশের সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য নয়।
কূটনৈতিক অসমতা ও চুক্তির অসম প্রয়োগ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যতগুলো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে, তার বেশিরভাগই ভারতের পক্ষে একতরফাভাবে কার্যকর হয়েছে। সীমান্ত চুক্তি, পরিবহন চুক্তি, বন্দর ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদারতা দেখালেও ভারতের তরফে পারস্পরিকতা অনুপস্থিত।ভারত মনে করে আওয়ামী লীগই হচ্ছে বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক এমন ধারনা ও ভয়ংকর মহাভুলের ওপর ভারত কি করে আজোও দাঁড়িয়ে আছে অবিশ্বাস্য এবং হাস্যকর ব্যাপার। বিগত স্বৈরশাসকের পুরোটা সময়ে আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখতো! কি তামাশাপূর্ণ ঘটনা;যাকে এককথায় বলা চলে সীমাহীন নৈরাজ্য নৈতিকতাহীন নির্লজ্জ চরিত্র।
শেষ কথা- বন্ধুত্ব না আধিপত্য?
বাংলাদেশের উচিত এখনই জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কৌশলগতভাবে বিদেশনীতি নির্ধারণ করা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে সমতার ভিত্তিতে, বন্ধুত্বের নামে গোলামির নয়। স্বাধীনতা শুধু কাগজে নয়, চেতনায় ও বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভারতের আগ্রাসন রোধে জনগণের মধ্যে জাতীয় সচেতনতা বাড়াতে হবে।নোবেলবিজয়ী প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আগামীর নতুন বাংলাদেশ একদিন আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হয়ে উঠবে—এই আশা নিয়েই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
২৯/০৪/২০২৫