পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিরতা: ধর্মের ছদ্মাবরণে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকি

: আবু তাহের পাটোয়ারী।।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম বহুদিন ধরেই একটি স্পর্শকাতর ভূখণ্ড। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, এই অঞ্চলের অশান্তি কেবল একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক কূটচাল ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা হুমকির রূপ নিচ্ছে। বিশেষত ‘মনোগীত জুম্মো’ ওরফে করুণালঙ্ক ঠাকুজ্জের মতো ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড এই অস্থিতিশীলতাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।

এই মনোগীত জুম্মো নিজেকে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে পরিচয় দিলেও তার আসল পরিচয় অনেক ভয়ংকর। বিভিন্ন সূত্র বলছে, সে জেএসএস (জানতা সংহতি সমিতি)-এর “পররাষ্ট্রমন্ত্রী” এবং ভারতে থেকে কার্যত অস্ত্র ও তহবিল সরবরাহের কেন্দ্রীয় দায়িত্বে রয়েছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুর ছদ্মবেশে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার এমন তৎপরতা পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এবং গোটা বাংলাদেশের জন্য এক বড় হুমকি।

২০১৯ সালে সে নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় “রিপাবলিক অফ জুম্মল্যান্ড” নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল। সেই লক্ষ্যে সে ভারত থেকে অস্ত্র আনয়ন, বিদেশি লবিং ও স্থানীয়ভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোতে লিপ্ত। মাস দুয়েক আগে মিজোরামে আটক হওয়া অস্ত্রের চালানের বিষয়েও সে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্ল্যাক মার্কেটের দামসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে-যা তার “ধর্মগুরু” পরিচয়ের সম্পূর্ণ বিরোধী।

তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এই বিচ্ছিন্নতাবাদ কেবল অস্ত্র নিয়ে সীমিত নয়, বরং তা একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। বাংলাদেশের শক্তিশালী হয়ে ওঠা রোধে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ‘সেফ বাফার জোন’ তৈরি করতে ভারত-সমর্থিত কিছু নেপথ্য শক্তি এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিচ্ছে। মনোগীত জুম্মোর মন্তব্য, “বাংলাদেশ মুসলিম দেশ হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠলে বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরা নির্যাতিত হবে”-এমন বক্তব্যও সরাসরি সাম্প্রদায়িক বিভাজন উসকে দেওয়ার শামিল।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রও নিশ্চুপ নেই। সম্প্রতি ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বে একটি গবেষণা প্রতিনিধি দল ইউপিডিএফ নেতাদের সাথে বৈঠক করেছে-যা থেকে ইঙ্গিত মেলে যে বাংলাদেশ সরকার কৌশলগতভাবে “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার” নীতি গ্রহণ করছে। যদিও ইউপিডিএফ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করলেও তারা জেএসএস-এর মতো প্রকাশ্য বিচ্ছিন্নতাবাদী নন।

এখন সময় এসেছে, এই বিষয়গুলো নিয়ে জাতীয়ভাবে খোলামেলা আলোচনা করার। শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দায়িত্ব দিয়ে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। রাষ্ট্রকে চাই দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক কৌশল, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক পদক্ষেপ, এবং সবচেয়ে বড় কথা—পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন।

নিষ্কর্ষে বলা যায়, মনোগীত জুম্মোর মতো চরিত্ররা যতদিন ধর্মের ছদ্মবেশে অস্ত্র ও রাজনীতির খেলায় লিপ্ত থাকবে, ততদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনা সম্ভব নয়। আমাদের চোখ খোলা রাখতে হবে, কারণ পর্দার আড়ালে সত্যিটা অনেক সময় পোশাকের আড়ালেই লুকানো থাকে।