অটোরিকশা-জনজীবনের জন্য নিঃশব্দ মরণফাঁদ-জরুরি ব্যবস্থা অনিবার্য

মো: আবু তাহের পাটোয়ারীঃ

বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থায় এক সময়ের বিকল্প গণপরিবহন হিসেবে পরিচিত হওয়া অটোরিকশা এখন শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র এক ভয়ংকর সমস্যার নাম হয়ে উঠেছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সম্প্রতি যে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে, তা নিছক কোনো দাবিনামা নয়—বরং দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও পরিবহন ব্যবস্থার প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ হুঁশিয়ারি।

আজ রাজধানীর ব্যস্ততম রাস্তাগুলোয় যানজট যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই যানজটের একটি বড় উৎস অটোরিকশা। এটি শুধু যাত্রী পরিবহনের নামে রাস্তা দখল করছে না, বরং ট্রাফিক শৃঙ্খলা ভেঙে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অধিকাংশ অটোরিকশা চালকই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাস্তায় নামছে, ট্রাফিক সিগনাল উপেক্ষা করে যত্রতত্র থামছে, উল্টো পথে চলার প্রবণতা তো আছেই। ফলে দুর্ঘটনার হার বাড়ছে, বাড়ছে ক্ষোভ এবং জনদুর্ভোগ।

শুধু দুর্ঘটনাই নয়, এই যানটির আরেকটি ভয়ংকর দিক হচ্ছে বিদ্যুৎনির্ভরতা। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চার্জ করার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলোর অনেকটাই সরবরাহ হচ্ছে অবৈধ সংযোগ থেকে। এতে দেশের জাতীয় গ্রিডে অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে গ্রামে-গঞ্জে কৃষকরা যেখানে সেচের জন্য বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে শহরের অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা চার্জিং স্টেশনগুলো দিনের পর দিন বিদ্যুৎ অপচয় করছে। এই বৈপরীত্য দেশের উন্নয়নকে করছে বাধাগ্রস্ত।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই যানটির পেছনে রয়েছে এক শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী মহল। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক চক্র অটোরিকশা আমদানি ও উৎপাদন চালু রেখেছে। এমনকি সরকারে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা ছাড়া এত বড় পরিসরে এই অনিয়ন্ত্রিত বাজার গড়ে ওঠা সম্ভব হতো না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতারা এটিকে ‘মানবসৃষ্ট মরণফাঁদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন-যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত যথাযথ।এ অটোরিকশাগুলো শহরে গ্রামে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা না করে চলাচল করতে গিয়ে পিছনে এসে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ধাক্কা মেরে যে-কোনো গাড়ির ক্ষতি করছে।রাস্তাঘাটে এসব নিয়ে দু’পক্ষের মাঝে প্রায়ই বাগ্বিতণ্ডা থেকে গড়িয়ে মারপিট পর্যন্ত হতে দেখা যায়।

এই পরিস্থিতিতে সরকার যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট এবং বিদ্যুৎ সংকট—এই তিনটি সংকট একসঙ্গে জাতীয় দুর্যোগে রূপ নিতে পারে। অটোরিকশার উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা, উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করা এবং এর যন্ত্রাংশ ব্যাটারি উৎপাদন- আমদানি নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।

বিকল্প হিসেবে সরকার ডিজেলচালিত ছোট পরিবহন, বিআরটিসির বাস, সিএনজি কিংবা বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনায় চালিত সোলার প্যানেল সিস্টেম আথবা আরো উন্নত কোন প্রযুক্তির মাধ্যমে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। প্রয়োজনে জোনভিত্তিক লাইসেন্স ব্যবস্থা চালু করে নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট সংখ্যক যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে প্রয়োজন শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত চালক তৈরির উদ্যোগ।

পরিশেষে বলা যায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত সর্বত্র একটি যন্ত্রনামার নাম হয়ে উঠেছে অটোরিকশা। আমরা আর কোনো প্রাণ হারাতে চাই না, আর কোনো অযাচিত যানজটে আটকে থাকতে চাই না। এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্তের—অটোরিকশা নয়, চাই নিরাপদ, নিয়ন্ত্রিত ও টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা।