মো:আবু তাহের পাটোয়ারী।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক ঘটনায় আমরা দেখেছি এক চরম বেদনাদায়ক মুহূর্ত—যখন ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়েন উপাচার্য, এবং তিনি আবেগঘন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, “তোরা মারবি আমাকে? মেরে ফেল আমাকে।” এ যেন এক ভিন্নমাত্রার দ্বন্দ্ব, যেখানে একজন শিক্ষকের কণ্ঠস্বর একসময়কার বাবার মতো, আবার একপর্যায়ে এক বিপন্ন মানুষের মতো কাঁপে। এসময় পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর সহধর্মিণী ও দুই কন্যা অশ্রুসিক্ত নয়নে হাহাকার করে উঠলে মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কিছু ছাত্র-ছাত্রী এগিয়ে এসে বলেন, “স্যার আমাদের শিক্ষক। তাঁর প্রতি অসম্মান হবে না।”
এই ঘটনার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রথমত, ছাত্রদের ক্ষোভ হঠাৎ জন্ম নেয়নি। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষার্থীদের প্রতি অবহেলা ও নানা ন্যায্য দাবিকে বারবার উপেক্ষা করার ফলেই এ ক্ষোভ জমা হয়েছিল। ছাত্রদের দাবির ভেতরে হয়তো কিছুটা আবেগ আছে, কিন্তু তার পেছনে রয়েছে প্রকৃত বঞ্চনার অভিজ্ঞতা।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে-এই ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা কী হওয়া উচিত? একজন উপাচার্য, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক, তাঁর দিকে হাত তুলে কিংবা অবমাননাকর আচরণ করে কি কোনো যৌক্তিক আন্দোলনের মর্যাদা রক্ষা করা যায়? যখন আমরা উপাচার্যের পরিবারকে কাঁদতে দেখি, তখন একটি মানবিক চিত্র আমাদের চোখে ভেসে ওঠে-কোনো আন্দোলনই যেন তার মানবিকতা হারিয়ে না ফেলে।
এটি কেবল এক ব্যক্তির বা এক ঘটনার কথা নয়। এটি আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার একটি প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ছাত্রদের সম্পর্ক যেন প্রতিনিয়তই উত্তেজনার দোলাচলে থাকে। একদিকে উপাচার্যের অবস্থান প্রশাসনিক সুবিধার কেন্দ্রবিন্দুতে, অন্যদিকে ছাত্ররা পড়ে থাকেন নানান সমস্যার জালে-আবাসন, নিরাপত্তা, শিক্ষা উপকরণ, কিংবা গণতান্ত্রিক চর্চার সংকটে।
এই পরিস্থিতি আমাদের একটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়: বিশ্ববিদ্যালয় কি কেবল ডিগ্রি বিতরণের একটি প্রতিষ্ঠান, নাকি তা চিন্তা, যুক্তি ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চার একটি ক্ষেত্র?
উপাচার্য যখন বলেন, “মেরে ফেল আমাকে,” তখন সেটি কোনো আত্মসমর্পণের ভাষা নয়, বরং একটি ভিন্ন ধাঁচের প্রতিবাদ-নিজের অসহায়ত্বের, বিচ্ছিন্নতার। এই বাক্য যেন গোটা ব্যবস্থার প্রতিই এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়-শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কি এতোটা শূন্যতায় নেমে গেছে?
শেষ পর্যন্ত, শিক্ষার্থীরা যখন উপাচার্যকে সম্মান জানান, তাঁকে ‘স্যার’ বলে আশ্বস্ত করেন, তখন আমাদের মনে হয়-না, সম্পর্কের সব সেতু এখনও ভেঙে পড়েনি। সংকট যত গভীরই হোক, মানবিকতাই আমাদের শেষ আশ্রয়।
এই ঘটনার আলোকে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি নতুন সংলাপ শুরু করা। বিশ্ববিদ্যালয় হোক নতুন ভবিষ্যতের নির্মাণশালা, যেখানে ক্ষমতা নয়, বিবেক হবে চালিকাশক্তি।