পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশের মিডিয়ায় সম্প্রতি শিরোনাম-“বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান এবার ভারতকে টুকরো-টুকরো করতে জোট গঠন করেছে।” শুনলেই শিরদাঁড়া উঠতে পারে, কিন্তু একটু থেমে ঘটনাটা যাচাই করলে দেখা যাবে, এ-ধরনের বর্ণনা আসলে ভূ-রাজনীতির জটিল বাস্তবতার চেয়ে ভয়ের মনস্তত্ত্ব ও সেলস-হেডলাইন-নীতির ফসল।
১. দাবিটির উৎস ও প্রেক্ষাপট
নির্বাচনী মৌসুম ও TRP-দৌড়
ভারতের লোকসভা নির্বাচন (২০২৪-২৫) ঘিরে “বাহ্যিক শত্রু” বয়ান উসকে দিয়ে অভ্যন্তরীণ সমর্থন সুসংগঠিত করা অনেক পুরোনো রাজনৈতিক কৌশল ভারতের। পাকিস্তান-ফ্যাক্টর সব সময়ই ‘ট্রায়েড-অ্যান্ড-টেস্টেড’ আর্কিটেকচার, এবার তাতে চীন ও বাংলাদেশ যোগ করে ‘ত্রিমুখী হুমকি’র এক নতুন ক্লিকবাইট জন্ম হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্সিলারেশন
ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের ফরোয়ার্ড সংস্কৃতি ‘অবিশ্বাস্য-কে-বিশ্বাস্য’ করে তুলতে সময় নেয় না। ফলে জটিল কূটনীতি ও সামরিক হিসাব নিকাশ মাত্র কয়েক লাইনের মিম-তত্ত্বে এসে ঠেকে।
২. কূটনৈতিক বাস্তবতা
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, ট্রানজিট ও বিদ্যুৎ বাণিজ্যে দ্বিপাক্ষিক নির্ভরতা এতটাই গভীর যে ‘ভূখণ্ড ছিন্নভিন্ন’-এর ধারণা অবাস্তব। ঢাকা-দিল্লি নিরাপত্তা সংলাপেই ২০১৭-এর পর থেকে ৫০-এর বেশি যৌথ অপারেশন হয়েছে।
চীনের কৌশল বেইজিং ভারতের বিরুদ্ধে ‘স্ট্র্যাটেজিক কমপিটিশন’ চালালেও-বিশেষ করে হিমালয় সীমান্ত ও ইন্ডিয়ান ওশান অঞ্চলে-ওরা কদাচ অ্যাট্রোফি-অফ-টেরিটরি কৌশল নিয়ে এগোয় না; বরং বাণিজ্য-নির্ভরশীলতা ও অবকাঠামো কূটনীতি (Belt & Road) তাদের মূল হাল।
পাকিস্তানের সক্ষমতা অর্থনৈতিক দেউলিয়ার মুখে থাকা ইসলামাবাদের পক্ষে বহুমুখী সামরিক অভিযান কীভাবে সম্ভব? ‘জোট’ থাক বা না থাক, বাস্তবে তারা নিজ সীমান্তই সামাল দিতে হিমশিম।
৩. ‘ত্রি-পাক্ষিক জোট’-এর সামরিক অঙ্ক
কমন কমান্ড স্ট্রাকচার নেই – ন্যাটোর মতো কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ভেতরে নেই।
লজিস্টিক্যাল দূরত্ব -পাকিস্তান থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে, বা চীন থেকে উপকূল ছুঁয়ে বাংলাদেশ হয়ে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ- প্রতিটি রুটই ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ‘অভ্যন্তরীণ লাইন-অব-কমিউনিকেশনের’ তুলনায় অসুবিধাগ্রস্ত।
পারস্পরিক সন্দেহ – বেইজিং-ইসলামাবাদ মিললেও, ঢাকা-ইসলামাবাদ ঐতিহাসিক আস্থার সংকটে বাঁধা; ১৯৭১-এর স্মৃতি এখনো জীবন্ত।
দুদেশ ধিরে ধিরে শিতলতার আবরনে ঢেকে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই। যুদ্ধ মতবিরোধ হতেই পারে কিন্তু তাই বলে চিরশত্রুতা আজীবন চলতে পারেনা। ৫৪ বছর আগের ঘটে যাওয়া দুদেশের হৃদয় বিদারক বিবেক এই প্রজন্ম আর মাথায় নিয়ে চলতে চায় না।ভারতের বড় মাথা ব্যথার আশঙ্কা এখানেই।বাংলাদেশ ভারতের দাদা গিরি মানতে মোটেও আগ্রহী নয়।
৪. মিডিয়ার ভূমিকা: ‘সিকিউরিটাইজেশন’ বনাম ‘সেন্সেশনালাইজেশন’
সিকিউরিটাইজেশন তত্ত্ব বলছে, নিরাপত্তার ভাষায় কোনও ইস্যু তুলে ধরলে তা জাতীয় অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু যখন সেটি তথ্যভিত্তিক নয়, তখন Sensationalization Polarization Policy-Distortion-এর দুষ্টচক্র তৈরি করে। ফলাফল-
১. অপ্রয়োজনীয় সামরিক ব্যয় বাড়ে;
২. গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষয় হয়;
৩. আঞ্চলিক সহযোগিতার দরজা আরও সংকুচিত হয়।
৫. কেন বাংলাদেশকে টেনে আনা হচ্ছে?
‘ড্যাম্পিং ইফেক্ট’ ন্যারেটিভ: তিস্তা জলবণ্টন বা রোহিঙ্গা ইস্যুতে দিল্লি-ঢাকার দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় মিলছে না-এ ফাঁকেই কলকাতার কয়েকটি ট্যাবলয়েড ‘বন্ধু-বিশাল সুবিধা হাতছাড়া’ এ কারনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
মেরুকরণ রাজনীতি: পশ্চিমবঙ্গের ভোটব্যাঙ্কে বাংলাদেশী-মুসলিম ইমেজটি ব্যবহারযোগ্য ইলেক্টোরাল টুল, তাই ‘বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান’ এক বাক্যে ফেলে তরঙ্গ সৃষ্টি করা সুবিধাজনক।
৬. সম্ভাব্য ফলাফল ও করণীয়
স্টেকহোল্ডার কী করতে পারে
গণমাধ্যম ক্রস-চেক করা তথ্য ছাড়া ‘জোট’ শব্দ ব্যবহার বন্ধ করা; সামরিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের যুক্তি তুলে ধরা।
নীতি-নির্ধারক (ভারত) নির্বাচনী বক্তৃতা ও বাস্তব নিরাপত্তা মূল্যায়ন পৃথক রাখা; সীমান্ত-পর্যবেক্ষণ ডেটা জনসমক্ষে আনা।
বাংলাদেশ জনকূটনৈতিক (পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি) মাধ্যমে বারবার স্পষ্ট করা-ঢাকার পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র “মৈত্রীর বন্ধন, সকলের সাথে, কারও বিরুদ্ধে নয়”।
শিক্ষিত নাগরিক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট শেয়ারের আগে উৎস যাচাই; ক্ষুদ্র আঞ্চলিক উত্তেজনাকে বৃহৎ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার চোখে দেখা।
৭. শেষ কথা আমাদের করনীয়
‘বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান জোট’- শব্দবন্ধটি যতটা রোমাঞ্চকর, বাস্তবে ততটাই ফাঁপা। এটি এমন এক “মিরেজ” যা ভয় ও ভোটের রাজনীতিকে পুষ্টি জোগাচ্ছে, কিন্তু ভূ-রাজনীতির কঠিন সমীকরণের সঙ্গে এর সামর্থ্যের ফারাক পাহাড়সম। তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ, সুস্থ সমালোচনা ও আন্তঃপ্রতিবেশী ট্র্যাক-২ সংলাপই পারে এই বিভ্রান্তির মেঘ ছিন্ন করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার আকাশ পরিষ্কার করতে।
মো: আবু তাহের পাটোয়ারী।। সম্পাদক, নবজাগরণ