রোহিঙ্গা সংকট, করিডোর রাজনীতি ও সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রনায়কসুলভ কৌশল

মো: আবু তাহের পাটোয়ারী:
রোহিঙ্গা ইস্যু এখন আর কেবল একটি মানবিক সংকট নয়-এটি পরিণত হয়েছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণের কেন্দ্র। এই সংকটকে ঘিরে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর আগ্রহ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কৌশলগত তৎপরতা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এর মাঝেই বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারউজ্জামান এর বক্তব্য-“আগে রোহিঙ্গাদের ফেরত নাও, তারপর করিডোর”- নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

এই বক্তব্য শুধু সাহসী নয়, এটি একটি দূরদর্শী কূটনৈতিক বার্তা, যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ভারসাম্য এবং সার্বভৌম স্বার্থ রক্ষায় সময়োচিত ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রোহিঙ্গা ইস্যুর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর নির্মম অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। জাতিসংঘ একে “পাঠ্যবইয়ের মতো জাতিগত নিধন” হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, বাস্তবে বড় কোনও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়নি। কিন্ত কেন?

কারণ হলো ভূরাজনীতি।

১. চীন-মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান মিত্র। রাখাইন রাজ্যের কিউকফিউ থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত “চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর (CMEC)” গড়ে তোলার স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন মিয়ানমারকে জাতিসংঘে বারবার রক্ষা করে যাচ্ছে।

২. ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি করা ভারতও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করছে। তারা একদিকে মানবিকতার কথা বললেও, অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক ও অবকাঠামোগত সহযোগিতা বজায় রেখেছে।

৩. রাশিয়া- অস্ত্র সরবরাহের বড় বাজার হিসেবে মিয়ানমারকে ছাড় দিতে রাজি নয় রাশিয়া।

৪. আসিয়ান (ASEAN)-সংস্থাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে, ফলে কার্যত কোনো চাপ তৈরি করতে ব্যর্থ।

এই ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলোর ছায়া পড়ছে করিডোর ইস্যুতেও।

করিডোর-অর্থনৈতিক সুযোগ না ভূরাজনৈতিক একটি ফাঁদ?

ভারত ও চীন উভয়েই বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমারে করিডোর খোলার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ভারত চাইছে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সহজে সংযোগ এবং চীন চাইছে তার “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ”-এর অংশ হিসেবে মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাতে।

কিন্তু বাংলাদেশ কী পাচ্ছে সুযোগ এর বিনিময়ে?
একদিকে রোহিঙ্গা সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে-অপরদিকে রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে নিরাপত্তা হুমকি, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান বেড়ে যাচ্ছে। করিডোর দিতে গেলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ভারসাম্য ক্ষতির মুখে পড়বে এতে অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাবে ।

সেনাপ্রধানের অবস্থান- কৌশল, সাহস ও নেতৃত্ব

ত্রিমুখী এই জটিল পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানের অবস্থান নিঃসন্দেহে এক রাষ্ট্রনায়কসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। তিনি করিডোর ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে একধরনের ভিন্নমত তুলে ধরে বলেছেন-রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে করিডোর নয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন:

১. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপস নয়।

২. মানবিক সংকটকে রাজনৈতিক সুবিধায় রূপান্তরের বিরুদ্ধে অবস্থান।

৩. আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রভাব মোকাবেলায় দৃঢ়তা।

এটি একপ্রকার কৌশলগত প্রতিরোধ (Strategic Leverage), যেখানে বাংলাদেশ তার ভূ-অবস্থানকে ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটি চাপ সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে।

করণীয়: রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক নতুন উদ্যোগ

বাংলাদেশের উচিত:
চীন ও ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে আরও কঠোর ভাষায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দাবি তোলা।

আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকিকে তুলে ধরা।

সেনাবাহিনীর অবস্থানকে রাজনৈতিক শক্তির অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় কৌশল গ্রহণ করা।

আমাদের করণীয় :
রোহিঙ্গা সংকট আর মানবিক ইস্যু নেই-এটি এখন জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত অস্তিত্বের প্রশ্ন। করিডোর একটি সম্ভাব্য সুবিধা হতে পারে, কিন্তু তা হতে হবে “Give and Take”-এর ভিত্তিতে। সেনাপ্রধানের স্পষ্ট ও দূরদর্শী অবস্থান তাই জাতির জন্য নতুন আশার বাতিঘর হয়ে উঠেছে।

আমরা যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থে বিশ্বাস করি-তাদের এক কণ্ঠে বলা উচিত: আগে রোহিঙ্গা ফেরত, তারপর করিডোর নিয়ে আলোচনা।

হ্যাশট্যাগ প্রস্তাবনা:
#রোহিঙ্গা_সংকট #ভূরাজনীতি #করিডোর_নয়_আগে_ফেরত #সেনাপ্রধান #বাংলাদেশ_প্রথমে #নবজাগরণ