নারী ও বোরকার অপরাধ: রাষ্ট্র যখন নিজেই সন্ত্রাসে মদদদাতা

নবজাগরণ ডেস্ক:
একটি স্বাধীন দেশে, যেখানে সংবিধানে ন্যায়ের আশ্বাস রয়েছে, যেখানে মানবাধিকারের শপথ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠিত হয়-সেই দেশেই আজ রাষ্ট্রীয় হেফাজতে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
নরসিংদীর মেঘনা ও মৌ নামের দুই তরুণীর ঘটনা তার এক ভয়াবহ উদাহরণ।

একটি মেয়ে, ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে টাকা তুলতে গিয়েছিল-সেই ছোট্ট সিদ্ধান্তটিই যেন তার জীবনের সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডির সূচনা। সাদা পোশাকে আসা কিছু ‘অচেনা’ লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়, চোখ-মুখ বেঁধে, মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে তার মানবাধিকারকে পদদলিত করে। তার অপরাধ? না, তার কোনো অপরাধ নেই। কেবল বোরকা পরে, নামাজ পড়ে, আর গরিব ঘরের মেয়ে-এই ছিল তার অপরাধ।

মৌকেও তুলে আনা হয় একই কায়দায়। এরপর শুরু হয় রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ভয়াবহ এক অধ্যায়-কোনো প্রাথমিক তদন্ত বা তথ্য ছাড়াই, নারী জঙ্গী নাটকের পর্দা উঠানো হয় মিডিয়ার সামনে। অথচ মেয়ে দুটো জানেই না ‘জঙ্গী’ কাকে বলে। তারা জানত শুধু পড়াশোনা, টিউশন, অসুস্থ মা-বাবার মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন।

ডিবি ও র‍্যাবের লোকেরা তাদের উপর চালায় অকথ্য নির্যাতন-মানবাধিকার লঙ্ঘনের সকল সীমা অতিক্রম করে। হাতকড়া লাগিয়ে রাখা, একবেলা খাবার বন্ধ, টয়লেটেও হ্যান্ডকাফ, দিনের পর দিন মারধর, এবং ভয়াবহ মানসিক নির্যাতন-সবই হয় রাষ্ট্রের নামে।

এরপর আসে সেই ভয়ঙ্কর ১৬৪ ধারা। স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে যে কাগজে সই নিতে বলা হয়, সেটা তারা পড়ে বুঝতেই পারেনি। ভয়, নির্যাতন ও ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতিতে বাধ্য হয়ে তারা সই করে-যার ফলাফল হয় জেল ও জীবনের পতন।

ছয় বছর ছয় মাস! কত স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এ সময়টায়? বাবা-মা হারিয়েছে মেয়েদের, স্বামী হারিয়েছে স্ত্রী, সমাজ একদল মানুষকে ‘জঙ্গী’ ট্যাগ দিয়ে চিরকাল আলাদা করে রেখেছে। অথচ বিচার হয়নি সেই র‍্যাব সদস্যদের, হয়নি ডিবির কর্মকর্তাদের জবাবদিহি। বরং তারা পুরস্কার পেয়েছে রাষ্ট্রীয় অপারেশনের সফলতার জন্য।

আজ মেঘনা ও মৌ জেল থেকে মুক্ত, কিন্তু তারা আর স্বাভাবিক না। চোখে এখনও সেই দিনগুলোর জলছাপ, গলায় কাঁপুনি, মনে অসহায়তা। প্রশ্ন একটাই-এই রাষ্ট্র কার? কার জন্য এই সংবিধান, এই মানবাধিকার? বোরকা পড়া গরিব মেয়েরা কি এই রাষ্ট্রের নাগরিক নয়?

এই রাষ্ট্র আজ জবাবদিহিহীন এক শাসনের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে অপরাধীদের চেয়ে নিরাপরাধরাই বেশি নির্যাতনের শিকার। গুম, খুন, মিথ্যা মামলা আর ‘জঙ্গী নাটক’-এই চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, বিশেষ করে বিরুদ্ধমত দমন আর ভিন্ন ধরণের মানুষের উপর নির্মম অত্যাচারের ছদ্মনামে।

আমরা মনে করি, এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিত। নির্যাতনকারী র‍্যাব-ডিবি কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে-নিরপরাধ মানুষের চোখের পানি দিয়ে কখনও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না।

শেষ প্রশ্নটি রাষ্ট্রের জন্য-
জঙ্গী দমন না জঙ্গী উৎপাদন-আপনারা কোনটা করছেন?