পলাশী থেকে চব্বিশ-প্রতিরোধের নতুন নাম ‘বাংলাদেশ’

মো: আবু তাহের পাটোয়ারী।।
পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হেনস্থা আর হত্যার দিনটি কেবল ইতিহাসের এক ব্যর্থ যুদ্ধের দিন নয়-তা ছিল এক জাতির মানসিক দাসত্বে পতনের দিকচিহ্ন। ক্লাইভ বুঝেছিলেন, একটি জাতিকে পরাজিত করতে বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রয়োজন হয় না-প্রয়োজন হয় ভেতরে থেকে তাদের বিশ্বাসঘাতক বানানোর। আর যে জাতি নিজের বীর পুরুষের অপমান উপভোগ করে, তাকে পদানত করতে বেশি কিছু লাগে না।

২০২৪ সালের চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের প্রজন্ম যেন ইতিহাসের উল্টো স্রোত ভেঙে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীরা যখন রাজপথে নেমে এসেছিল, তখন তাদের হাতে ছিল না কোনো অস্ত্র, ছিল না কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় পরিচয়। কিন্তু তাদের চোখে ছিল স্বপ্ন-দেশ বদলানোর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, এবং সবচেয়ে বড় কথা, আত্মমর্যাদার পুনর্জাগরণের।

রাষ্ট্রীয় বাহিনী, পুলিশ, আনসার, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা ঘৃণ্য গুন্ডাবাহিনী যখন নিরস্ত্র ছাত্রদের গুলি করে, নির্যাতন করে, হত্যা করে-তখন আমরা আবার দেখতে পাই পলাশীর সেই ভিড়, যারা দাঁড়িয়ে থেকে নবাবের অপমান দেখেছিল কিন্তু প্রতিরোধ করেনি। কিন্তু এবার ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করতে দেয়নি। কারণ, এইবার রাজপথে যারা রক্ত দিয়েছে, তারা শুধু বিরোধিতা করেনি-তারা বাঁচিয়ে রেখেছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে।

ভারতের সাথে সম্পাদিত একের পর এক দেশবিরোধী গোপন চুক্তি যখন কাগজে কলমে আমাদের সার্বভৌমত্ব খেয়ে নিচ্ছে, তখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, প্রশাসন, আদালত-সব যেন নিশ্চুপ। আর যারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তাদের হত্যায় যেন রাজনীতি, রাষ্ট্রযন্ত্র আর মিডিয়া হাত মিলিয়ে এক নিষ্ঠুর অন্ধকার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ইতিহাস জানে, এই অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়।

রবার্ট ক্লাইভ যেমন বাঙালির মানসিকতা বিশ্লেষণ করে পলাশী জিতেছিলেন,ভারতের কৃতদাস শাসকরাও সেই পথ ধরেই নিজেদের নিরাপদ ভাবছে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে-এই প্রজন্ম ক্লাইভের চোখে দেখা সেই জাতি নয়। তারা প্রতিরোধ জানে, তারা প্রশ্ন করতে শেখে, তারা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে শেখে। তারা বিজয়ের জন্য নয়, তারা সত্যের জন্য লড়ছে। এই চব্বিশের প্রজন্ম-এই বাংলার নব বিপ্লবীরা-তারা জানে, রক্ত গেলে ইতিহাস জাগে।

আমরা ভুলে যাব না রাজপথে ঝরে পড়া শহীদ সন্তানদের-যারা চেয়েছিল পড়ালেখা শেষে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে, একটি ন্যায্য চাকরির আশা করতে। রাষ্ট্র তাদের গুলি করে হত্যা করেছে, কিন্তু ইতিহাস তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শহীদরা, নিখোঁজরা, রক্তাক্ত ছাত্ররা আহতরা-তারা বাঙালির সেই নতুন ইতিহাসের ভিত্তি রচনা করছে, যা পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতা থেকে একেবারে আলাদা।

তাই আজ সময় এসেছে দাঁড়াবার। ইতিহাসকে পুনরায় লিখবার। যারা ভারতের দালালি করে চুক্তি করেছে, যারা নিরপরাধ ছাত্রদের হত্যা করেছে, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জাতিকে শোষণ করেছে-তাদের বিচার চাই, চাই জনতার আদালতে, চাই চেতনার মঞ্চে।

এইবার কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না নীরবে। এইবার ঢিল ছুঁড়বে লাখো হাত, এইবার কেউ কাঁটাওয়ালা সিংহাসনে বসে বিনোদনের শিকার হবে না-এইবার তারাগুলো রক্ত দিয়ে জ্বলে উঠবে, যারা পলাশীর বদলা নিতে চায়-ভবিষ্যতের জন্য।

চব্বিশের বিপ্লবীদের কণ্ঠে বাংলাদেশ আজ কথা বলে। এই বাংলাদেশ ভয় পায় না। মাথা নত করে না। এই বাংলাদেশই একদিন সব দালালের, সব বিশ্বাসঘাতকের শেষ বিচার করবে।

১৬ বছরের শাসনব্যবস্থায় ব্যর্থতার চূড়ান্ত নজির রেখে গেছে সমস্ত রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী। ভারতের সাথে ১০টি দেশবিরোধী চুক্তি হয়েছে-কেউ সাহস করেনি প্রশ্ন তুলতে, প্রতিরোধ গড়তে। এইসব চুক্তির বিরুদ্ধে যখন দেশের তরুণ প্রজন্ম রাজপথে নেমে আসে, তখন তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। কোটাসংস্কার আন্দোলনে যে তরুণরা শহীদ ও আহত হয়েছে, তারা ছিল এদেশের মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারের সন্তান—তাদের স্বপ্ন ছিল বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর। রাষ্ট্র তাদের সেই স্বপ্নকে গুলি করেছে, পিতামাতার বুক খালি করেছে, জনগণের আশা-ভরসা ভেঙে চুরমার করেছে।

এখন সেই একই রাষ্ট্রীয় অপারেটাস-সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার কিছু কুলীন অংশ একত্রিত হয়ে আবারো ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। কিন্তু এবার তারা ভুল করছে। কারণ এবার যিনি সামনে আছেন, তিনি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-একজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নোবেলজয়ী, এক বিস্ময়কর বাঙালি, যিনি শোষণহীন বিশ্বগড়ার স্বপ্ন দেখান। তার বিরুদ্ধে যখন ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকা হচ্ছে, কোটি কোটি জনগণ আজ জেগে উঠেছে-বুক ফুলিয়ে বলছে: “আমরা আছি ইউনূসের পক্ষে, আমরা আছি পরিবর্তনের পক্ষে!”

এই ষড়যন্ত্র শুধু একজন মানুষকে নয়, বরং গোটা পরিবর্তনের স্বপ্নকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। যারা এটা করছে, তারা জানে-ইউনূস সাহেবের নেতৃত্ব মানেই দুর্নীতিবাজদের বিচার, দালাল চক্রের পতন, ন্যায়ের পক্ষে নতুন বাংলাদেশ। সুতরাং তারা তাকে থামাতে চায়। কিন্তু এইবার তারা জনতার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ জনতা প্রস্তুত-গর্জে উঠেছে এক নবজাগরণের মহাস্রোত।

ড. ইউনূস একা নন। তার পেছনে আছে ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কৃষক, প্রবাসী বাঙালি, শিক্ষক-সাংবাদিকসহ কোটি কোটি মানুষের আস্থা। যারা বলছে: “ষড়যন্ত্র নয়, এবার চাই পরিবর্তন; প্রতিহিংসা নয়, চাই সত্যের বিজয়!