মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
সম্প্রতি এক বা একাধিক সচিবের মন্তব্য জাতিকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিয়েছে-ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সরকারকে ‘আগুনে হাত না দিতে’ হুঁশিয়ারি, না হলে ‘হাত পুড়ে যাবে’। এটি কি নিছক বাক্যবন্ধ, না কি এর পেছনে লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অন্তর্নিহিত এক ভয়ংকর প্রতিচ্ছবি?
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী-সচিব পদে আসীন কেউ যদি প্রকাশ্যে সরকার ও জনগণকে হুমকি দিতে পারেন, তাহলে তা কেবল অশোভন নয়, বরং সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান। জনগণের অর্থে বেতনভুক্ত আমলাদের এই ঔদ্ধত্য গণতন্ত্র ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার ওপর একটি স্পষ্ট চপেটাঘাত।
এই হুমকি যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা যেন ভুলে গেছেন-এই দেশের মালিক ১৮ কোটি জনগণ। আমরাই কর দেই, আমরাই শ্রম দেই, আমরাই ভোট দেই। কোনো সচিব বা আমলা জনগণ ও সরকারের উর্ধ্বে নন। আমরা সেই আগুন নিভাতে প্রস্তুত, যে আগুন জনগণের বিরুদ্ধে ছুড়ে দেওয়ার দুঃসাহস কেউ দেখাবে।
সরকারি চাকরি আইন ২০২৫: শৃঙ্খলা না নিপীড়ন?
অপরদিকে, সম্প্রতি জারি হওয়া “সরকারি চাকরি আইন ২০২৫” নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এই আইনের কয়েকটি ধারা-বিশেষ করে অনুগত্য না থাকলে ৭ দিনের মধ্যে চাকরিচ্যুতি, কোনরূপ শুনানি বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়াই-চিন্তার খোরাক জোগায়।
এই আইন প্রয়োগে নিরীহ, নিম্ন বা মধ্যম গ্রেডের কর্মচারীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত নারী কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে এক ভয়ানক দমন নীতি। আমলার ইচ্ছানুযায়ী না চললে “অশোভন আচরণ” বা “অনুগত্যের ঘাটতি” দেখিয়ে তাঁদের হয়রানির মুখে পড়তে হতে পারে।
এতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেই, নেই ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, অবৈধ সম্পদের বিষয়ে কোন কঠোরতা। বরং এমন একটি আইন পাশ করা হয়েছে যা শুধুমাত্র অধীনস্থ কর্মচারীকে ‘দাসে’ পরিণত করার পথ তৈরি করে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
আমলাতন্ত্র বনাম জনতার রাষ্ট্র
আমলারা দেশের চালিকাশক্তি-এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য হলো তাঁরা জনগণের সেবক। আমলাতন্ত্র যদি নিজেকে শাসকের ভূমিকায় দাঁড় করায়, রাষ্ট্র তখন স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়।
আমরা সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শত প্রতিকূলতায় যাঁরা সৎভাবে কাজ করেন, তাঁদের কষ্ট আমরা বুঝি। কিন্তু তাই বলে আমলাদের হাতে এমন এক তরবারি তুলে দেওয়া, যা যেকোনো মুহূর্তে নিরীহ মানুষের ঘাড়ে নেমে আসতে পারে, তা কখনোই কাম্য নয়।
যাঁরা বলছেন ৯০% সরকারি কর্মচারী ঘুষখোর, তাঁরা যেমন ভুল করছেন; তেমনি যাঁরা সবকিছুতে আমলাদের ‘দেবতা’ বানাতে চান, তাঁরাও রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতি করছেন।
আমরা কোথায় দাঁড়াবো?
আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা থাকবে; আবার সেই রাষ্ট্র যেন কর্মচারীদের অনিরাপদ করে না তোলে। আমরা এমন একটি প্রশাসন চাই, যেখানে সচিবরা জনগণের ভাষায় কথা বলবেন, ভয় দেখাবেন না।
আজ সময় এসেছে দাঁড়াবার। প্রশ্ন করার। আইন পড়ার, বুঝার। এবং অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলার।
নইলে আজ আগুনে হাত পুড়বে সরকারের, কাল জ্বলবে গোটা জাতি।