বিদেশি মানেই অপরাধী? সাউথ আফ্রিকায় প্রবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বাস্তবতা

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:

জোহানেসবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা

আবদুল মালেকের মুখে হতাশার ছায়া। সাত বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে তার ছোট্ট মুদি দোকানটি ছিল পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। বৈধ কাগজপত্র, লাইসেন্স, এমনকি করও নিয়মিত পরিশোধ করেছেন। কিন্তু গত সপ্তাহে একদল দুর্বৃত্ত তার দোকানে ঢুকে লুটপাট চালায়। পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলে অফিসার সোজা উত্তর দিলেন-“তুমি বিদেশি, তোমাদের নিয়ে সমস্যা অনেক।”

মালেক একা নন, তার মতো হাজারো অভিবাসী এখন সাউথ আফ্রিকায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

রাষ্ট্রীয় দমননীতি- বিদেশিরা মানেই সন্দেহভাজন

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ অভিযান’ নামে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা কার্যত এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নে রূপ নিচ্ছে। পুলিশি ধরপাকড়, বৈধ ব্যবসা বন্ধ, রাস্তায় নির্বিচারে আটক ও মারধরের অভিযোগে প্রবাসী কমিউনিটিগুলো আতঙ্কিত।

“সকালে কাজে বের হলে জানি না সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে পারব কি না,”-বলছিলেন মুকুন্দা নামের এক জিম্বাবুয়ান যুবক।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এসব পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান-উভয়েরই পরিপন্থী।

সংবিধান বনাম বাস্তবতা

দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান তার ভূখণ্ডে অবস্থানরত সব মানুষের জন্য মানবিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটি United Nations Convention on the Protection of the Rights of All Migrant Workers এবং African Charter on Human and Peoples’ Rights-এর সাথেও অঙ্গীকারবদ্ধ।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অভিবাসীরা দিনকে দিন হয়ে উঠছে ‘ঘৃণার পাত্র’। সরকারি ভাষায় তারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’, আর জনমনে তারা ‘চাকরি চোর’, ‘অপরাধী’ কিংবা ‘অসামাজিক উপাদান’।

“পুলিশ দেখলে বুক ধড়ফড় করে”- ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা

নবজাগরণ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী প্রবাসী:

“আমি স্কুলে পড়ি, বাবা রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। গত সপ্তাহে বাসা থেকে বের হতেই দুইজন পুলিশ এসে আমার কাগজ চাইল। দেখানোর পরও বলে ‘এসব ভুয়া’। আমাকে ৩ ঘণ্টা ধরে রাস্তায় বসিয়ে রেখেছিল”-বলছিলেন ১৭ বছর বয়সী সোমালিয়ান তরুণ ইদ্রিস।

এক নাইজেরিয়ান ব্যবসায়ী বলেন, “তারা শুধু বিদেশি দেখলেই ধরে নিয়ে যায়। টাকা দিলে ছাড়া পায়, না দিলে জেল। আমরা কোথায় যাবো?”

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ

Amnesty International ও Human Rights Watch সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, “দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে চলমান এই দমননীতি মানবাধিকার চুক্তির সম্পূর্ণ লঙ্ঘন।”

United Nations High Commissioner for Refugees (UNHCR)-এর দক্ষিণ আফ্রিকা শাখাও একটি নোটিশে জানিয়েছে-“সরকারকে অবিলম্বে এই ধরনের আচরণ বন্ধ করে মানবিক ও আইনি রক্ষাকবচ জোরদার করতে হবে।”

আন্তর্জাতিক মহলে অভিযোগ জানাতে প্রস্তুতি

বাংলাদেশি ও জিম্বাবুয়ান প্রবাসীদের যৌথ উদ্যোগে বর্তমানে একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত করা হচ্ছে, যা জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের নিকট পাঠানো হবে। এতে প্রবাসীদের উপর নিপীড়নের ভিডিও-চিত্র, লিখিত জবানবন্দি এবং আইনি নথিপত্র যুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন বাংলাদেশী প্রবাসী। আরো জানিয়েছেন নির্বিচারে গত কয়েক বছরে বহুসংখ্যক বাংলাদেশীদের হত্যা করেছে আফ্রিকান দুর্বৃত্তরা।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলাদেশী প্রবাসীদের সুরক্ষিত পরিবেশে নিরাপদে বসবাসের জন্য জরুরি উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য।

মানবিক রাষ্ট্র নাকি আতঙ্কের উপনিবেশ?

একটি আধুনিক রাষ্ট্র তখনই সভ্য হয়, যখন তা দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। দক্ষিণ আফ্রিকা তার অতীতে বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু আজ সেই রাষ্ট্রে বিদেশিদের বিরুদ্ধে যে আচরণ চলছে, তা সেই আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

সাউথ আফ্রিকার নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমাদের জোরালো আহ্বান-
বিদেশিদের অপরাধী না বানিয়ে, তাদের আইনি অধিকার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করুন।
অবিলম্বে দমনমূলক অভিযান বন্ধ করুন এবং সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তুলুন।

আপনি যদি প্রবাসে থাকেন এবং এই বিষয়ে যে কোনো সমস্যা আপনার অভিজ্ঞতা বা মতামত শেয়ার করতে চান, নবজাগরণকে লিখুন