মৌলিক সংস্কারহীন নির্বাচনের ফাঁদে আবারও দানবে পরিণত হবে শাসকগোষ্ঠী

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী :
প্রকাশ: নবজাগরণ ১ জুন ২০২৫

“সংস্কারহীন নির্বাচন মানেই দানবের পুনর্জন্ম”- ড. বদিউল আলম মজুমদার

সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক গণসংলাপে সুজন সম্পাদক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন:“যদি আমরা গঠনমূলক, মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার না করি, তবে নির্বাচনের নামে আবারও একদল শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসবে, যারা ধীরে ধীরে দানবে রূপ নেবে। ভোট হবে, কিন্তু গণতন্ত্র নয়-জন্ম নেবে বৈধ কর্তৃত্ববাদের নতুন রূপ।”

এই বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক মতামত নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গম্ভীর সতর্কবার্তা।

ভোটের নামে ক্ষমতা: পরিবর্তন নয়, পুনরাবৃত্তি

স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে মোট ১১ বার, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আরও কয়েকশো। কিন্তু জনজীবনে তার সুফল কোথায়? কেন দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনও ১২০তম (Transparency International, 2023)?

ঢাকার গার্মেন্টস শ্রমিক হাসিনা বেগম বলছেন:“ভোট তো দেই, কিন্তু আমার বাচ্চার স্কুল বন্ধ, পেট চালাতে রিকশা টানি। যে পার্টিই জিতুক, আমার কিছুই বদলায় না।”

রাজধানীর গুলশানে বসবাসকারী এক সাবেক ব্যাংক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন:“আজকের রাজনীতি একটা ব্যবসা। আপনি বিনিয়োগ করেন, এমপি হন, তারপর সেই লগ্নি ফেরত পান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, প্রজেক্টে দুর্নীতি করে, অথবা বিদেশে টাকা পাচার করে।”

২২ পরিবার থেকে ২২ হাজার লুটেরা

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানে ‘২২ পরিবারের’ শাসন নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কি আমরা সেই একই রূপকথার শিকার?

তথ্যসূত্র (CPD, 2023):বাংলাদেশের মোট সম্পদের ৮৭% আছে শীর্ষ ১০% ধনীর হাতে।দেশের ৫০% দরিদ্র মানুষের ভাগে মাত্র ৮% সম্পদ।

বিগত দশকে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বিদেশে।

কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?ড. বদিউল আলমসহ বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের পরামর্শ অনুযায়ী মৌলিক সংস্কারের কয়েকটি জরুরি দিক হলো:
স্বাধীন নির্বাচন কমিশন: নিয়োগের পদ্ধতিতে নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার: অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সকল নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট।

অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা: নির্বাচনে অর্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: দলীয় প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা ছাড়া বিচার চর্চা হয় না, হয় দলীয় প্রতিহিংসা।

মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ: মুক্ত গণমাধ্যম এবং সক্রিয় নাগরিক সমাজ ছাড়া গণতন্ত্র শুধু শব্দের খেলা।

সাক্ষাৎকার: একজন তরুণ শিক্ষার্থী কী ভাবছে?

নাম: রাফিদ হাসান, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

“নির্বাচন মানে এখন কেবল কার রঙিন ব্যানার বেশি, আর কার গায়ে ক্ষমতার ছায়া। আমরা যারা ভোট দিই, তাদের কারো স্বপ্নে গণতন্ত্র নেই, আছে বেঁচে থাকার লড়াই।”

শেষ কথা: ব্যালট নয়, কাঠামোর সংস্কার চাই

নির্বাচন নয়, প্রয়োজন সেই কাঠামোর বদল যা ভোটকে অর্থবহ করে।
আমরা চাই এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে একজন খেতমজুর আর একজন কর্পোরেট ধনীর ভোট সমান মূল্যবান হয়-যেখানে নির্বাচন কমিশন হুকুমের দাস নয়, স্বাধীন সংগঠন হয়-যেখানে জনগণ শুধু ভোটার নয়, সত্যিকার অর্থে নাগরিক হয়ে ওঠে।

নবজাগরণ এই প্রশ্ন তোলে:
আগামী নির্বাচন কি একটি প্রহসনের পুনরাবৃত্তি হবে? নাকি এ দেশের নাগরিকরা দাবী করবে সত্যিকারের সংস্কার?
নির্বাচন নয়, ‘সংস্কার’ হোক আগামী রাজনৈতিক আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য।