মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
ঈদুল আজহার নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে মাংসের গন্ধে ভরা সকালের স্মৃতি, অলিগলিতে রক্তধারার প্রবাহ, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে-একটি বিস্তৃত সামাজিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসবের চেহারা বদলেছে। বদলেছে মানুষের অংশগ্রহণের ধরন, পশু বাছাইয়ের রীতি, এমনকি এই উৎসবকে ঘিরে গড়ে ওঠা অর্থনীতিও।
ঐতিহাসিক পটভূমি: ঢাকার প্রথম কোরবানির হাট
ঐতিহাসিক দলিল ও সাহিত্যে উঠে এসেছে যে, একসময় ঢাকায় কোরবানির ঈদের আগেই কড়াকড়ি ছিল গরু জবাইয়ে। তখন কোরবানির আমেজ সীমিত ছিল পুরনো ঢাকার বনেদি পরিবারে। সেই সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় হাট ছিল রহমতগঞ্জের গণি মিয়ার হাট। মিরকাদিম থেকে আনা গরু এখানকার আকর্ষণ ছিল।
পুরনো দিনের কোরবানির ঈদ ছিল নিরহংকার, মূলত ধর্মীয় চেতনায় আবদ্ধ। গরু কিনতে গিয়ে সামাজিক প্রতিযোগিতা বা প্রদর্শনের মনোভাব তখনও জন্ম নেয়নি। বরং কোরবানি ছিল আত্মত্যাগ, আত্মশুদ্ধি এবং গরিবদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগির একটি অনাড়ম্বর উপলক্ষ।
একটা গরুর দাম মাত্র ৩০ টাকা!
ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, ১৯৫০-এর দশকে একটি গড়পড়তা গরুর দাম ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা। ঢাকায় তখন লোকসংখ্যাও ছিল কম। ঈদের আগে গাবতলী, সোয়ারীঘাট ও জিঞ্জিরার হাট থেকে গরু কিনতেন মানুষজন। তখনকার হাটে গরু ছাগল ছাড়াও ভেড়া থাকলেও, হুমড়ি খেয়ে পড়া ভিড় বা গ্ল্যামার ছিল না।
শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন স্মৃতিচারণ করেছেন-“ঈদের তিন চার দিন আগে থেকে দাবড়ে বেড়াতাম পুরো মহল্লায়, কে কত বড় আর সুন্দর গরু কিনল, দেখার জন্য”। তখনও সামাজিক প্রতিযোগিতা ব্যক্তিগত ও সরল আনন্দে সীমাবদ্ধ ছিল।
ধর্মীয় উৎসব থেকে ‘প্রদর্শনী’র সংস্কৃতিতে উত্তরণ
সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে কোরবানির মূল ব্যাখ্যা ও অভিব্যক্তি। এখনকার কোরবানির হাটগুলো যেন মিনি চিড়িয়াখানা বা গরুর র্যাম্প শো। বাহাদুর, সম্রাট, কালু, লালু, কিংবা শাকিব-বুবলী নামধারী গরু নিয়ে মানুষের উন্মাদনা-এ যেন ঈদ নয়, ‘ইভেন্ট’। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ও ভিডিও আপলোড করে ‘লাইক’ আর ‘রিচ’ পাওয়ার প্রতিযোগিতাই হয়ে উঠেছে মুখ্য।
গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে মেট্রোপলিটন-সবখানে এখন ঈদুল আজহা মানেই বাজারমূল্য, পশুর দৈহিক আকৃতি ও দামে প্রতিযোগিতা। ধর্মীয় অনুশাসন কিংবা আত্মত্যাগের মূল বার্তা কোথাও যেন ঝাপসা হয়ে গেছে।
আর্থ-সামাজিক রূপান্তর: ঈদ এখন এক বিশাল অর্থনীতি
একটি সাধারণ পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে কোরবানির পশুর বাজারের আর্থিক পরিসর ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই অর্থনীতিতে জড়িত খামারি, চাষি, গরু পরিবহনকারী, হাট ইজারাদার, কসাই, চামড়া ব্যবসায়ী, ফ্রিজ ও মাংস প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি পর্যন্ত।
এক সময় যেখানে কোরবানি ছিল সীমিত, এখন সারাদেশে কয়েক হাজার হাট বসে। এই হাটগুলোর নাম, গরুর পরিচিতি, এমনকি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিও এখন কর্পোরেট মডেলে চলে। ‘মেজর বাহাদুর’ বা ‘টাইগার শাহরুখ’ নামের গরুদের ঘিরে তৈরি হয় মিডিয়া কভারেজ, ইউটিউব ব্লগ, স্পন্সরড পোস্ট।
এই সামাজিক প্রদর্শনী একদিকে শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্তকে চাপের মধ্যে ফেলে, অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা চালায়। এই দ্বৈত বাস্তবতা আমাদের ভাবায়-আমরা কি এখনো ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করছি, নাকি সামাজিক মর্যাদা রক্ষার এক অলিখিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি?
সময়ের প্রশ্ন: আত্মত্যাগ না আত্মপ্রদর্শন?
ইসলামের মূল চেতনা আত্মত্যাগ, আত্মশুদ্ধি ও মানবিক সংবেদনশীলতা। অথচ আজ কোরবানির ঈদ হয়ে উঠেছে ধনপ্রদর্শনের এক প্রতিযোগিতামূলক মেলা। মানুষ যত বড় গরু কোরবানি দিতে পারে, তত বেশি সামাজিক মর্যাদা দাবি করে।
এই চিত্র কি প্রমাণ করে না-আমরা ঈদের অন্তর্নিহিত বার্তা ভুলে গেছি?
বকরি ঈদ-কোরবানির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা হোক:
ঐতিহাসিক বিবরণে দেখা যায়, কোরবানির উৎসব এক সময় ছিল বিশ্বাস, ভাগাভাগি ও সংযমের প্রতীক। আজকের কর্পোরেট ও সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর কোরবানিতে সেই বার্তা ক্রমেই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
আমাদের দরকার এক সামাজিক পুনর্বিন্যাস, যেখানে ঈদুল আজহা হবে আত্মত্যাগ ও সহানুভূতির উদযাপন-not a show of economic muscles.