“আমি প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পাঁচ থেকে আট আউন্স প্রস্রাব পান করি”-এই মন্তব্য শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন মার্কিন টিভি সাংবাদিক ড্যান রাথার। সময়টা ১৯৭৮। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই আমেরিকার সঙ্গে ইন্দিরা আমলে ছিন্ন হওয়া সম্পর্ক জোড়া লাগাতে হঠাৎ উড়ে যান ওয়াশিংটনে। একইসঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গেও ‘বন্ধুত্ব’ গড়ার চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। নিজের ‘জোটনিরপেক্ষ’ পররাষ্ট্রনীতিকে বলেছিলেন ‘প্রকৃত নিরপেক্ষতা’। টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “ভারত আর তার প্রতিবেশীদের বিরক্ত করতে চায় না।”
এই ‘ভদ্রলোক’ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন যে, একদিন সাউথ ব্লকে বসে ব্যক্তিগতভাবে জিয়াকে ফোন করে বলেছিলেন-“আপনাদের পারমাণবিক প্রকল্পের সব খবরই আমাদের জানা। ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আপনাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রেখেছে।”
ফলাফল? পাকিস্তান বুঝে ফেলে তাদের তথ্য কে সরবরাহ করছে। আইএসআই তখন ঠান্ডা মাথায় ভারতীয় গুপ্তচরদের শনাক্ত করে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাহুটা পারমাণবিক প্রকল্পে ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। ভারত পিছিয়ে পড়ে অন্তত এক দশক।
‘র’ ভেঙে ফেলার পেছনের নায়ক
মোরারজি দেশাই ‘র’-এর বাজেট ৩০% ছাঁটাই করেন, প্রতিষ্ঠাতা আর এন কাওকে ছুটিতে পাঠান, এবং উত্তরসূরি কে শঙ্করন নায়ারকেও ছেঁটে ফেলেন। অথচ সেই সময় ‘র’-এর মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ও চীন।
বি রমন তাঁর বই “The Kaoboys of R”-এ লেখেন, ১৯৭৮ সালে ভারতের কাছে কাহুটা প্ল্যান্টের নীলনকশা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল পাকিস্তানের এক বিজ্ঞানী। বিনিময়ে তারা চাইছিল মাত্র ১০,০০০ ডলার। কিন্তু মোরারজি দেশাই মানবতাবাদ ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার দেখিয়ে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেন।
একই যুক্তিতে দেশাই ব্যর্থ করেন ইজরায়েলের সঙ্গে করা কাহুটা ধ্বংসের যৌথ অপারেশনও। ইজরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশে দায়ানের সঙ্গে গোপন বৈঠকে তিনি বোমারু বিমানকে জ্বালানি দেওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান। এই অপরিণামদর্শিতার মূল্য ভারতকে দিতে হয় ৪৭ বছর ধরে।
জিয়াউল হকের সঙ্গে ‘পিস লাভার’ দেশাই
জিয়াউল হক রীতিমতো চাতুর্যের সঙ্গে দেশাইয়ের ইউরিন থেরাপির ভক্ত সেজে কথা বলতেন। ফোনে জিজ্ঞাসা করতেন-“মহামান্য, দিনে কয়বার প্রস্রাব পান করা উচিত?” এমন মোলায়েম কথোপকথনের ফাঁদেই দেশাই একদিন ফাঁস করে দেন ভারতের সমস্ত পাকিস্তানভিত্তিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের পরিচয়।
এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে আজ ভারতকে হুমকি দিয়ে চলে।
আরএসএস ও বিজেপির নীরব সমর্থন
মোরারজি দেশাই তখন জনতা সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি এবং তথ্যমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি। তাঁরা কেউই প্রতিবাদ করেননি। বরং পরবর্তীকালে কে আর মালকানি (প্রাক্তন RSS নেতা) বলেন, “দেশাইকে সম্মান জানিয়ে পাকিস্তান নিজেকে সম্মানিত করেছে।”
এই ‘সম্মান’-এর ফলস্বরূপ ১৯৯১ সালে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে দেশাইকে প্রদান করে ‘নিশান-এ-পাকিস্তান’—যা সেই দেশের সর্বোচ্চ সম্মান। এর আগে ১৯৮৮ সালে জিয়াউল হক ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু নিজের মৃত্যুর কারণে সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
ভারতের পেছনে পড়ার কারণ: কাহুটা ষড়যন্ত্র
১৯৭৫-৭৭ সালের মধ্যেই ভারত নিশ্চিত হয়েছিল পাকিস্তান গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। কাহুটায় চুল পরীক্ষার মাধ্যমে ভারত প্রমাণ পায়। এরপর শুরু হয় একটি দুঃসাহসিক অপারেশনের পরিকল্পনা। কিন্তু দেশাই সেই পরিকল্পনা নিজেই ধ্বংস করে দেন।
পরে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে এসে ইজরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে কাহুটায় হামলার ছক কষেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনাও ফাঁস করে দেয় সিআইএ। ফলে পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা তৈরির পথ মসৃণ হয়। ভারতের জন্য তৈরি হয় এক চিরস্থায়ী হুমকি।
শেষ কথা:পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র-এই বাস্তবতা আজ ভারতের মাথাব্যথার প্রধান কারণ। এই ভয়ংকর সত্যের বীজ বপন করেছিলেন একজন প্রধানমন্ত্রী-মোরারজি দেশাই। তিনি শুধু একটি নেটওয়ার্ক ধ্বংস করেননি, ধ্বংস করেছিলেন গোটা জাতির নিরাপত্তা।
আজও প্রশ্ন ওঠে-এই বিশ্বাসঘাতকতা ভুলে যাওয়া কি সম্ভব?
সম্পাদনা ও বিশ্লেষণ:মো: আবু তাহের পাটোয়ারী
প্রকাশিত: নবজাগরণ