জুলাই বিপ্লব-শাসক নয়, শাসনব্যবস্থা বদলের ডাক!

 

মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
“কোনো জাতি সত্যিকারভাবে স্বাধীন হতে পারে না, যদি তার শাসনব্যবস্থা দাসত্বের চর্চা চালিয়ে যায়।”
-ম্যালকম এক্স

জুলাই বিপ্লবের এক বছর পর আমরা কি আত্মবিশ্লেষণ করেছি? আমরা কি খতিয়ে দেখেছি-এই অভূতপূর্ব গণজোয়ারের মূল কথা কী ছিল? না কি আমরা এটাকে শুধুই ‘ক্ষমতা পরিবর্তনের’ একটি রোমাঞ্চকর মুহূর্ত বলে ভুলে যাচ্ছি?

সত্যি বলতে, জুলাইয়ের সেই দ্রোহ কেবলমাত্র একদল দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ডাক ছিল না। এটা ছিল ব্যবস্থার শিকড় উপড়ে ফেলার প্রথম ঘোষণা। মানুষ পথে নেমেছিল এক নতুন রাষ্ট্র-দর্শনের আকাঙ্ক্ষায়-যেখানে রাষ্ট্র হবে নাগরিকের, বিচার হবে সবার জন্য সমান, এবং উন্নয়ন হবে শুধুমাত্র এলিট শ্রেণির জন্য নয়, সবচেয়ে নিচুতলার মানুষের জন্যও।

ক্ষমতার বদল নয়, ক্ষমতার উৎস বদলের লড়াই

বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুবার “ক্ষমতা পরিবর্তন” হয়েছে-

১৯৭৫ সালে বন্দুকের জোরে,
১৯৮২ সালে সামরিক কু থেকে,
১৯৯০-এ গণআন্দোলনের মাধ্যমে,
২০০৭-এ একদল ‘সিভিল-মিলিটারি ম্যানেজার’ দিয়ে,
সর্বশেষ ২০২৪-২৫ এ জুলাই বিপ্লবের নামে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- এই সব পরিবর্তনের পর সাধারণ মানুষের জীবনে মৌলিক কী বদলেছে?

নদী, বন, খনিজ, কৃষিজমি- সবকিছু লুটপাটের ছাঁচ একই রয়ে গেছে।
আইনের চোখ আজও অন্ধ, তবে শুধু ক্ষমতাবানের অপকর্মে।
স্বাধীনতা এসেছে কাগজে-কলমে, শাসন এসেছে শোষণ হয়ে।

জুলাই বিপ্লব সেই চক্র ভাঙার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন!

বিপ্লব কাকে বলে?
বিপ্লব মানে শুধু ব্যানার, মিছিল বা ভাষণ নয়।
বিপ্লব মানে-

যিনি শাসক হবেন, তিনি জনগণের সেবক হিসেবে থাকবেন, মালিক হিসেবে নয়।

রাষ্ট্রযন্ত্র- প্রশাসন, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা- থাকবে জনগণের জবাবদিহিতার অধীনে।
শিক্ষা হবে মুক্তির হাতিয়ার, চাকরির নয়।

কৃষি ও শিল্প হবে বহুজাতিকের মুনাফা নয়, মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য।

এই সবকিছুরই বিরোধী ছিল পুরনো শাসনব্যবস্থা। আর তাই জনগণ কেবল শাসক নয়, ব্যবস্থা বদলেরই ডাক দিয়েছিল জুলাইয়ে।

কে এই বিপ্লবকে ভয়ে চেপে দিতে চায়?
১. যারা মনে করে রাষ্ট্র মানেই ‘উপরে নির্দেশ, নিচে
২. যারা শিক্ষিত, কিন্তু জনগণের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় পায়।
৩. যারা মিডিয়ার মালিক হয়ে বিপ্লবকে “নৈরাজ্য” বানাতে চায়।
৪. যারা “স্থিতিশীলতা”র নামে সমাজকে জমাট দাসত্বে বেঁধে রাখতে চায়।

এই গোষ্ঠী আজ আবারও জেগে উঠেছে। তারা চায়- জুলাই বিপ্লব কেবল স্মারক হয়ে থাকুক, নীতির নয়। তারা চায়- কিছু মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় বা মসনদ বদল হোক, কিন্তু পুলিশি দমন, শিক্ষায় বাণিজ্যিক আগ্রাসন, বিচারহীনতা, কৃষক-শ্রমিকের দারিদ্র্য- সব অপরিবর্তিত থাকুক।

বিপ্লবের নতুন পর্ব শুরু হোক
এখন সময় এসেছে জনগণের সেই অনমনীয় স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করার-

আমরা ক্ষমতার দালাল চাই না,
আমরা চাই এক নতুন শাসনব্যবস্থা-
যেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের,
এবং সমাজ হবে ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক, মুক্তচিন্তার।

এই নতুন পথ তৈরির জন্য দরকার:
রাজনীতির বিকল্প ভাষা সৃষ্টি: দল নয়, দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতি।

গণসংগঠনের নবজাগরণ: শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-নারী-সব শ্রেণিকে সংগঠিত করতে হবে ক্ষমতা নির্মাণের ভিত্তিতে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব: যে চেতনা দাসত্বকে ‘নিয়তি’ বলে শেখায়, তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।

নির্বিশেষে আমাদের করণীয়:
জুলাই বিপ্লব হয়েছিল সাহসী চেতনার জন্ম দিতে-
একটি নতুন বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা করতে।
শুধু সরকার বদল নয়,
শাসনব্যবস্থার রূপান্তরই জুলাই বিপ্লবের মূলমন্ত্র।

এই মূলমন্ত্রকে ভুলে গেলে, আমরা ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকব।
তাই বলতে হয়-
বিপ্লব চলছে, চলবেই- যতক্ষণ না পর্যন্ত শোষকের প্রতিটি স্তম্ভ ধসে পড়ে,
আর জনগণ হয়ে ওঠে সত্যিকারের রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক।