মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
ঈদ-আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আবেগের নাম। কিন্তু এই ঈদের আনন্দ যদি বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে নিঃশব্দে নিঃশেষ হয়, যদি কোরবানির মাংস রক্ষা নয়, বরং নষ্ট হওয়া ঠেকানোতেই মানুষের প্রধান ব্যস্ততা হয়-তাহলে সে উৎসব আর কতটা আনন্দদায়ক থাকে?
আমি এক বছর পর শহর থেকে প্রিয় জন্মস্থান, নোয়াখালীর সেনবাগে ঈদ করতে এসেছি দেখছি মানুষের মাঝে চরম কষ্ট। প্রবাসী অনুজ বলছে;সেখানে থেকেও মনে করতাম, ঈদ মানেই বাড়ি ফেরার খুশি, প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটানো সময়, আর গ্রামীণ জীবনের নির্মল প্রশান্তি। কিন্তু বাস্তবে এসে যে অভিজ্ঞতা হলো, তা নিছক হতাশাজনকই নয়, হৃদয়বিদারকও।
অন্ধকারে বন্দি ঈদ
ঈদের দ্বিতীয় দিন গভীর রাত-সময় প্রায় তিনটা। গরমে অতিষ্ঠ মানুষ রাস্তায় হাঁটছে। ছোট-বড় সবাই বিদ্যুৎবিহীন ঘরে একরকম বন্দি। এমনকি গভীর রাতেও কোনো আলো নেই, ফ্যান নেই, ঠাণ্ডা পানিও নেই। যারা বৃদ্ধ, শিশু বা রোগী, তাদের কষ্ট ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।
এখানে লোডশেডিং কেবল সময়ের ব্যাপার নয়, মানুষের দৈনন্দিনতা এবং সামাজিক জীবনের উপর এক চরম আঘাত। বিদ্যুৎ বিভাগ যেন ঈদের সময়কেও উপেক্ষা করছে। অথচ ঈদের সময় দেশের প্রতিটি পরিবার বাড়তি প্রস্তুতি নেয়-খাবার, সংরক্ষণ, অতিথি আপ্যায়ন-সবকিছুই নির্ভর করে বিদ্যুতের উপর।
ফ্রিজে মাংস নয়, মাংসে দুঃস্বপ্ন
কোরবানির মাংস সংরক্ষণের জন্য যেখানে শহরে আধুনিক ফ্রিজিং গুদাম, সেখানে গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে বিদ্যুৎই নেই। ফলে মাংস দ্রুত পচে যাচ্ছে। মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, সাথে সাথে মানসিক চাপও বাড়ছে। ঈদের মতো আনন্দময় দিনে এই অনিশ্চয়তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য।
প্রবাস থেকে আসা এক অনুজ জানালেন, গত এক সপ্তাহ ধরে ঘরে ঘুমানোর মতো পরিস্থিতি নেই। তীব্র গরম, বিদ্যুৎ নেই, ফ্যান চলে না-সারা রাত জানালার পাশে বসে ঘামতে ঘামতে কাটে। এমন ঈদ কেউ কখনও আশা করে না।
শহর বনাম গ্রাম: বৈষম্যের নতুন চেহারা
শহরের মানুষ যেমন বিদ্যুৎ-পানির মৌলিক সুবিধা নিয়ে ঈদ উদযাপন করছে, তেমনি গ্রামের মানুষ ঈদেও ঠাঁই পাচ্ছে না একটি সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে। এটা শুধু বৈষম্য নয়, এ যেন রাষ্ট্রের উপেক্ষার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শহরভিত্তিক উন্নয়ন, শহরকেন্দ্রিক নীতিনির্ধারণ এই বৈষম্যকে দিনদিন বাড়িয়ে তুলছে।
অনেকে শহর থেকে গ্রামে আসার কথা ভেবেও আসেননি বিদ্যুতের এই অবস্থার কথা জেনে। ফলে ঈদের সেই আন্তরিক মিলন, পারিবারিক বন্ধন, প্রজন্মান্তরের সংযোগ-সবই ভেঙে পড়ছে।
দায় কার?
দেশে মেগা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রা’, ‘উন্নয়নের রোল মডেল’-এসব স্লোগানের বাস্তব প্রতিফলন কোথায়? সেনবাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলায় এখনও যদি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকে, তাহলে প্রশ্ন তো উঠবেই।
এটা কি কেবল বিদ্যুৎ ঘাটতির সমস্যা? নাকি বাজেটের দুর্বলতা, রাজনৈতিক অগ্রাধিকারহীনতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি এবং অব্যবস্থাপনার সমষ্টিগত ফল?
সময় এসেছে গ্রামীণ বিদ্যুৎ নীতির পুনর্বিন্যাসের
সরকারকে এখনই গ্রামীণ বিদ্যুৎ কাঠামোর দিকে নজর দিতে হবে। সেনবাগের মতো এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগ এবং কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। একইসাথে ঈদের মতো উৎসবের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিশেষ নজরদারিও থাকতে হবে।
গ্রামেই যদি মানুষ টিকে থাকতে না পারে, তাহলে সেই গ্রামে উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? প্রবাসে থাকা লাখো বাঙালি, যারা ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসেন-তাঁদের প্রতি দায়টুকু রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
টাকা দিয়েও পরিসেবা থেকে বঞ্চিত জনগণ-চরম জনদুর্ভোগ থেকে মুক্তি চায়:
ঈদের আনন্দ সকলের জন্য। শহরের জন্য নয়, নির্বাচিতদের জন্য নয়, গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর জন্যও নয়। তাই সেনবাগের মত জনবহুল এলাকায় বিদ্যুৎহীন ঈদ শুধু অব্যবস্থাপনার চিত্রই নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় উন্নয়ন দর্শনের এক নির্মম প্রতিবিম্ব।
আমরা চাই, ঈদের আলো যেন কেবল শহরে নয়-গ্রামের প্রতিটি ঘরেও পৌঁছে যায়। আমরা চাই, সরকারের উন্নয়নের আলো কেবল বিজ্ঞাপনে নয়-বাস্তব জীবনেও ছড়িয়ে পড়ুক।
মো: আবু তাহের পাটোয়ারী –
লেখক ও সমাজ-পর্যবেক্ষক
(জন্মস্থান: সেনবাগ, নোয়াখালী)
www.thenabjagaran.com