নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
রংপুর, জুন ৫, ২০২৫ : আসন্ন ঈদ বাজারকে সামনে রেখে এক অসাধু চক্রের অভিনব প্রতারণার চিত্র উন্মোচিত হলো রংপুরে। আলুর হিমাগারে বিপুল পরিমাণ মিষ্টি ও দই মজুত করে ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ও অধিকারের সঙ্গে ছিনিমিনি খেলার এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা রুখে দিয়েছে এক যৌথ অভিযান। বুধবার (৪ জুন) রাতে রংপুর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জোয়ার্দার আসিফ ইকবালের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানে সেনাবাহিনী ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, যা এই অনৈতিক কারবারের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানেরই প্রতিফলন।
অভিযানের নেপথ্যে
রাত দশটা থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এই শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। শহরের ময়না কুটি এগ্রো কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেডে যখন অভিযান দল প্রবেশ করে, তখন তাদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। আলুর পরিবর্তে হিমাগারের শীতল কক্ষে থরে থরে সাজানো ছিল প্রায় সাত হাজার কেজি মিষ্টি ও দই! যেন আলুর বস্তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক মিষ্টির পাহাড়, যা ঈদের বাজারে সহজ সরল ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে পুষ্টির মালিকপক্ষ মুনাফা অর্জনের অপেক্ষায় ছিল।
অভিযান চলাকালীন ময়না কুটি এগ্রো কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেডের এক কর্মকর্তা জানান, শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘পুষ্টি’ কোম্পানি তাদের মিষ্টি এখানে রেখেছিল। চাহিদা বেশি থাকার অজুহাতে তারা হিমাগার ব্যবহার করেছে, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ঈদের বিশেষ চাহিদা পূরণের জন্যই এই মিষ্টিগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এটি যেন এক অলিখিত চুক্তির ফসল, যেখানে অধিক মুনাফার লোভে স্বাস্থ্যবিধির সকল নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়েছেন রংপুরের নামকরা মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী পুষ্টি কর্তৃপক্ষ।
আইনের কষ্টিপাথরে
রংপুর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জোয়ার্দার আসিফ ইকবাল স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, হিমাগারে আলুর পরিবর্তে মিষ্টি মজুত করা সম্পূর্ণ অবৈধ। এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য মিষ্টির দোকান মালিক ও কোল্ডস্টোরেজ কর্তৃপক্ষ উভয়কেই ১ লাখ টাকা করে মোট ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তারা স্বীয় দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন, যা তাদের অপরাধের গুরুত্বকেই নির্দেশ করে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বিষয়টিকে ‘মানুষের সঙ্গে প্রতারণা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, হিমাগারে দীর্ঘদিন ধরে মজুত করা এসব মিষ্টি ও দই স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মজুতকৃত সকল মিষ্টি ও দই তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, যা অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য এক সুস্পষ্ট বার্তা।
সেনাবাহিনীর ৭২ পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “ঈদকে সামনে রেখে লম্বা সময় ধরে কোল্ডস্টোরেজের মধ্যে আলুর পরিবর্তে বিভিন্ন প্রকার দই ও মিষ্টি মজুত করে রাখা হয়েছিল। মিষ্টিগুলো ঈদের আগে ও পরে বাজারে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল।” তাঁর এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, একটি সুপরিকল্পিত উপায়ে ভোক্তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে মুনাফা লুঠের চেষ্টা চলছিল।
এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে যে, পুষ্টির মালিক পক্ষের মত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ক্ষণিকের লাভের আশায় দীর্ঘদিন থেকে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। তবে, রংপুর জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এই যৌথ ও সময়োপযোগী অভিযান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি একদিকে যেমন অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য সতর্কবার্তা, তেমনি অন্যদিকে ভোক্তাদের জন্য আশার আলো। ভবিষ্যৎে এমন প্রতারণা রুখতে এই ধরনের অভিযানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি