মো: আবু তাহের পাটোয়ারী।।
বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ থেকে উপজেলা সদর-সবখানেই বিদ্যুৎ এখন আর বিলাসিতা নয়, মৌলিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার রক্ষার দায় যাঁদের, তাঁরাই কি গৃহস্থের কাঁধে অনিয়ন্ত্রিত খরচ চাপিয়ে দিচ্ছেন? পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পিবিবো)-এর “মিটার কিনেও মাসে মাসে মিটার ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ”-এই অস্বস্তিকর দাবিটি ঘিরে দেশজুড়ে ক্ষোভ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
১. মিটার-মালিকের গলায় আবার ভাড়া-দড়ি?
ক. মিটার কেনা মানে মালিকানা হস্তান্তর
গ্রাহকরা আগেই এককালীন টাকা দিয়ে প্রিপেইড/পোস্টপেইড মিটার কিনেছেন। মালিকানা যেহেতু গ্রাহকের, তাই সেই সম্পদের উপর নিয়মিত ভাড়া চাপানো কোনো যুক্তিক কাঠামোর সঙ্গে মানানসই নয়।
খ. আইন ও বিধিমালার অস্পষ্টতার সুযোগ
বিদ্যুৎ আইন-২০১৮-এর ৫৪(ঘ) ধারা পরিষ্কারভাবে গ্রাহকের মালিকানাধীন যন্ত্রে অতিরিক্ত চার্জ নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক কমিশনের অনুমতি চায়। বাস্তবে ওই অনুমতির প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ বেআইনী এখনও বিশদ নির্দেশিকা নেই।
গ. ট্যারিফ কাঠামোর দ্বৈত বোঝা
বিদ্যুতের ইউনিট মূল্যের সঙ্গে আলাদা ডিমান্ড চার্জ, মিটার ভাড়া, সার্ভিস চার্জ যোগ হলে শেষমেশ Effective Tariff বেড়ে যায় ৭-৯% পর্যন্ত-যা শহুরে বিতরণ কোম্পানির চেয়ে বেশি।
ঘ. আন্তর্জাতিক তুলনা:
ভারত, নেপাল ও ভুটানে যা হয়
দেশ মিটার সরবরাহ মাসিক চার্জ মন্তব্য
ভারত (আম্বেদকর নগর) সংস্থাই ‘স্মার্ট মিটার’ ফ্রি ইনস্টল করে মাত্র ১০-২০ রক্ষণাবেক্ষণ ফি মালিকানা কোম্পানির; গ্রাহক ভাড়া দেয় না
নেপাল গ্রাহককে কিনতে হয় কোনও মাসিক মিটার ভাড়া নেই কেবল পড়ার ফি ইউনিট মূল্যে অন্তর্ভুক্ত
ভুটান সরকারি অনুদানে মিটার শূন্য সেবাকে সামাজিক পণ্য হিসেবে দেখছে।
বি:দ্র: যেখানে গ্রাহক কিনে, সেখানে ভাড়া অস্তিত্বহীন; যেখানে সংস্থা দেয়, সেখানে সামান্য রক্ষণাবেক্ষণ ফি-এই সরল ছকই আন্তর্জাতিক রীতি।
ঙ. অর্থনৈতিক ও নৈতিক ফলাফল
দ্বিগুণ আদায়ের অভিযোগ : একবার পুঁজি ব্যয় (CapEx) ফেরত পাচ্ছে, আবার অপারেশন খরচ (OpEx)-এর নামে মাসিক আদায়-“ডাবল রিকভারি”।
গ্রামীণ ব্যয়ের ওপর ঋণচাপ : ২০২৪-২৫ অর্থবছরের গ্রামীণ পরিবারের গড় বিদ্যুৎবিল ১২-১৫% পর্যন্ত বেড়েছে, যার ৩-৪%‐পয়েন্ট মিটার ভাড়া-সার্ভিস চার্জজনিত।
সামাজিক আস্থা ক্ষয় : রাষ্ট্রিয় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ‘গরিবের শত্রু’ ইমেজ তৈরি হচ্ছে; দীর্ঘমেয়াদে বিল পরিশোধে অনীহা ও মিটার টেম্পারিং বাড়ার ঝুঁকি।
চ. সমাধানে যা জরুরি
১. নিয়ন্ত্রক কমিশনের জরুরি হিয়ারিং
বিইআরসি (Bangladesh Energy Regulatory Commission)-কে ৩০ দিনের মধ্যে জনশুনানি ডেকে স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দিতে হবে-কোন ব্যয়ে মিটার ভাড়া যুক্তিযুক্ত?
২. “One-off Ownership” নীতিমালা
গ্রাহক যখন মিটার কিনে ফেলেছেন, তখন মিটার ভাড়া শূন্য-এ কথা গেজেটে স্পষ্ট করতে হবে। কেবল ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণ ফি (যদি থাকে) ইউনিট দরের ভেতর সামঞ্জস্য করে যোগ করা যেতে পারে।
৩. টেকসই রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল
ভাড়ার বদলে প্রতিটি মিটারের বিক্রয়মূল্যের ৫% একটি সেন্ট্রাল Escrow Fund-এ জমা রেখে সেখান থেকে রিপ্লেসমেন্ট ও সার্ভিস খরচ মেটানো যেতে পারে।
৪. প্রিপেইড-স্মার্ট মিটার রোল-আউট
স্মার্ট মিটার মূল্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র এনে সরাসরি সংস্থার দায়ে ইনস্টল করলে গ্রাহক-মালিকানা ও ভাড়ার দ্বন্দ্বই থাকবে না।
৫. আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপরেখা
ডিজিটাল স্বাক্ষর অভিযান : অনলাইনে লক্ষাধিক স্বাক্ষর তুলে বিইআরসি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি পাঠানো।
গণশুনানি-লাইভস্ট্রিম : ফেসবুক-ইউটিউবে হিয়ারিং সরাসরি সম্প্রচার করে গণচাপে স্বচ্ছতা বাড়ানো।
আইনি রিট : ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ ও সংবিধানের ১৫(ক) ধারা (জীবনযাত্রার মান) উল্লেখ করে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা (PIL) দায়ের।
নির্বিশেষে
গ্রামীণ বিদ্যুৎ “আলো দিয়েছে”-এ কথা সত্য, কিন্তু একই আলো যদি অবিচারের দগদগে ক্ষত উন্মোচন করে, তা হলে উন্নয়নের ছবিতে কালো দাগ পড়ে। মিটার-ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ বাতিল কেবল অর্থনৈতিক স্বস্তিই দেবে না; রাষ্ট্র-নাগরিক আস্থার সেতুতেও নতুন পিলার বসাবে। এখন সিদ্ধান্ত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার-তাঁরা কি জনতার যুক্তিসঙ্গত আওয়াজ শুনবেন, নাকি ‘অমানবিক জুলুম’ চালিয়ে আস্থাহীনতার অন্ধকার বাড়াবেন?
কাবলি ওয়ালা চরিত্রের নীতি বিরোধী দেশের জনগণ।
শেয়ার করুন, আওয়াজ তুলুন
#AwaajTolo2025 #MeterBhinnoChargeNoshto #RuralPowerJustice #নবজাগরণ #highlights2025 #reelsviralシ #fyp #StarSenderReels