মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
৫ আগস্ট ২০২৪-বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন একটি স্বাধীনতার দিন। ছাত্র ও সাধারণ জনগণের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া গণঅসন্তোষ এক ঐতিহাসিক বিস্ফোরণে রূপ নেয়। প্রশাসনের ভিতরকার ফাটল এবং সর্বোপরি জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ-এসব মিলিয়ে একচ্ছত্র স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ৫৪ বছরের শোষণ, দুঃশাসন ও জাতীয় প্রতারণার অবসান হয়। এবার প্রশ্ন-এই বিপ্লবের পরে রাষ্ট্র কীভাবে পুনর্গঠন হবে? নেতৃত্ব দেবেন কে? এবং নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবিক রাষ্ট্রনায়ক কীভাবে এই পথ দেখাতে পারেন?
বিপ্লব সফল, কিন্তু এখন শুরু প্রকৃত যুদ্ধ-রাষ্ট্র নির্মাণের যুদ্ধ
প্রথমেই মনে রাখতে হবে-একজন স্বৈরাচার পতনের নামই বিপ্লব নয়, বরং একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণই হলো বিপ্লবের সার্থকতা। আমাদের সামনে এখন পাঁচটি মৌলিক কাজ রয়েছে, যেখানে ইউনূস সাহেবকে কেবলমাত্র উপদেষ্টা নয়, নেতৃত্বদানকারী প্রাজ্ঞ কাণ্ডারী হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে।
১. নতুন সংবিধান রচনা-গণপরিষদের মাধ্যমে
বর্তমান বিতর্কিত সংবিধান বাতিল করে একটি জনগণনির্ভর গণপরিষদ গঠন করতে হবে। এই গণপরিষদ হবে রাজনৈতিক দলবিহীন, শ্রমজীবী, কৃষক, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্বে গঠিত। এটি একমাত্র প্ল্যাটফর্ম যেখান থেকে ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশ গঠনের মৌলিক নকশা (blueprint) তৈরি হবে।
ড. ইউনূসের ভূমিকা:
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এই গণপরিষদ গঠনের পথনকশা তিনি দাঁড় করাতে পারেন।
২. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ-কেন্দ্র ভাঙো, মানুষ জাগাও
দলীয় দখলে থাকা আমলাতান্ত্রিক যন্ত্র ভেঙে দিতে হবে। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে জনসভা-ভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণ চালু করতে হবে-যেখানে প্রতিটি স্তরে জনগণের সমবেত প্রতিনিধি পরিষদ কাজ করবে, তদারকি করবে এবং বাজেট নিয়ন্ত্রণ করবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে: বলিভিয়ায় মোরালেস এভাবে স্থানীয় ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
৩. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা-গণ আদালতের মাধ্যমে দুঃশাসনের বিচার
গত ষৌল বছরের দুর্নীতি, গুম, হত্যাকাণ্ড, ব্যাংক লুট, নির্বাচন কারচুপির জন্য গণ-ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। এতে বিচারক হবেন জনপ্রিয়ভাবে নির্বাচিত সমাজ প্রতিনিধি ও অভিজ্ঞ আইনবিদগণ। দলীয় আদালতের যুগ শেষ-এখন বিচার হবে জনগণের মঞ্চে।
৪. অর্থনীতির ভিত্তি হবে ‘সামাজিক ব্যবসা’ ও সমবায়
ব্যাংককেন্দ্রিক পুঁজিপতিশ্রেণির একাধিপত্য ভেঙে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সোশ্যাল বিজনেস মডেল ও শ্রমিক-নেতৃত্বাধীন সমবায় অর্থনীতি। গার্মেন্টস থেকে কৃষি পর্যন্ত প্রতিটি খাতে মালিকানা থাকবে জনগণের হাতে-মুনাফা নয়, কল্যাণ হবে চালিকাশক্তি।
ড. ইউনূসের ভূমিকা:
নিজের প্রবর্তিত “Social Business” মডেলকে রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ করে তিনি এক নতুন মানবিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করতে পারেন।
৫. নতুন রাজনৈতিক কাঠামো-দল নয়, জনগণই হবে সংগঠন
পচা দলতন্ত্রের জায়গায় আনতে হবে জনজোট ভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো। স্কুল-কলেজ, কারখানা, হাটবাজারে গঠিত হবে “জনমঞ্চ”-যেখানে জনগণ সরাসরি রাষ্ট্রীয় বিষয়ে মত দেবে, তদারকি করবে, প্রশ্ন করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে এখন যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব
৫ আগস্টের বিপ্লব তাকে এক অনন্য সময়ের মুখোমুখি এনেছে। তাঁর জ্ঞান, গ্রহণযোগ্যতা, দলনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি এবং বিকল্প অর্থনৈতিক চিন্তা-সব মিলিয়ে তিনি এখন এই নবনির্মিত বাংলাদেশে “প্রধান উপদেষ্টা” নয়, বরং এক “নতুন রাষ্ট্রের রূপকার” হতে পারেন।
তাঁর করণীয় হবে-
জনগণের প্রতিনিধিত্বে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় পরিষদ গঠন
নতুন সংবিধান রচনার পথ সুগম করা
বিচার ও শুদ্ধি প্রক্রিয়ার পর্যবেক্ষণ
বিকল্প মানবিক অর্থনীতির ছক রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন
এবং সর্বোপরি ক্ষমতার চক্র ভেঙে জনগণের হাতে রাষ্ট্র ফিরিয়ে দেওয়া
নির্বিশেষে জনগণের প্রত্যাশা ও করণীয়
৫ আগস্টের বিপ্লব আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিয়েছে। এখন দরকার একটি দ্বিতীয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-যেখানে গণতন্ত্র শুধু ভোট নয়, বরং প্রতিদিনের রুটি-রুজি, বিচার, সম্মান, ভাষা ও অধিকার। এই রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে যদি ড. ইউনূস সত্যিই তাঁর জায়গা অমর করে রাখতে চান, তবে এখনই সময়-সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার,এবং জনগণের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে নেতৃত্ব দেওয়ার।