মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
মিরপুর স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর সময় গেট ভেঙে লোকজন ডুকে পড়া শুরু করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিরসনের জন্যে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে সেনাবাহিনী এমন সময় নিরপরাধ একজন পতাকা বিক্রেতা শিকার হন লাটির আঘাত।ঘটনা শোনে ক্ষমা চেয়ে ১ লক্ষ টাকা হকারকে প্রদান করেন সেনাবাহিনীর সদস্যগণ।এমন বিরল দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ প্রসংশায় সেনাবাহিনী।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অপারেশনে অনিচ্ছাকৃতভাবে একজন নিরীহ নাগরিক নিহত হন। অত্যন্ত প্রশংসনীয় বিষয় হলো-এ ঘটনার পর সেনাবাহিনী নিজে থেকে তা স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছে এবং নিহত ব্যক্তির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ৫ লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে।
এই আচরণ শুধু প্রশাসনিক শুদ্ধাচারের দৃষ্টান্ত নয়, এটি সাহসিকতার এক ব্যতিক্রম উদাহরণ। কারণ, সত্য স্বীকার করা, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় শক্তির অবস্থান থেকে, সহজ কাজ নয়। অধিকাংশ সময় এমন ভুল গোপন করা হয়, দায় অস্বীকার করা হয়, বা তুচ্ছ ব্যাখ্যার আড়ালে চাপা পড়ে যায়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেখানেই আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা আর কী চাই?
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়-যদি একটি শক্তিশালী সংস্থা ভুলের দায় স্বীকার করে, তাহলে বিচার বিভাগ বা পুলিশ বাহিনী কেন পারবে না?
বাংলাদেশে এরকম বহু উদাহরণ আছে, যেখানে নিরপরাধ মানুষ ভুল তদন্ত, ভুল স্বীকারোক্তি বা রাজনৈতিক চাপের কারণে বছরের পর বছর কারাভোগ করেছে।
যেমন:
জসিম নামের একজন মানুষ, যিনি প্রকৃত অপরাধী গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রমাণিত হয় তিনি ২১ বছর ধরে ভুলভাবে কারাবন্দী ছিলেন। তাঁর জীবনের এই মূল্যবান সময়ের জন্য কেউ দুঃখপ্রকাশ করেনি, কোনও ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি।
শাজাহান বাচ্চু হত্যা মামলায় ভুলভাবে গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন নির্দোষ ব্যক্তির একাধিক বছর জেলে থাকার পরে জামিন পেলেও, রাষ্ট্রীয় কোন দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষতিপূরণ দেখা যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ডিএনএ ও ফরেনসিক পরীক্ষায় নির্দোষ প্রমাণিত কয়েক ডজন বন্দীর মুক্তি মিললেও, তাদের জীবন থেকে যে বছরগুলো চুরি গেছে, তার দায় রাষ্ট্র নেয়নি।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের দায় ও ক্ষতিপূরণ
যুক্তরাজ্যে কিংবা কানাডায় কেউ ভুলভাবে জেলে গেলে, তাকে মুক্তির পর সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়, এবং সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া হয়।
উদাহরণস্বরূপ, David Milgaard নামের কানাডিয়ান নাগরিক ২৩ বছর কারাবন্দী থাকার পর নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং ১০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পান।
তাহলে প্রশ্ন আসে:
বাংলাদেশে কেন রাষ্ট্র এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে না?
আমরা চাই রাষ্ট্র তার ভুলের দায় স্বীকার করুক।
আমরা চাই-
প্রধান বিচারপতি বলুন: “এই ভুল আমাদের বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা ছিল।”
পুলিশ প্রধান বলুন: “আমরা একজন নিরপরাধ মানুষকে অন্যায়ভাবে বন্দি রেখেছিলাম-আমরা দুঃখিত।”
সরকারপ্রধান বলুন: “রাষ্ট্র তার নাগরিকের জীবন নিয়ে অন্যায় করেছে-আমরা অনুতপ্ত, আমরা ক্ষতিপূরণ দেব।”
এটাই আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার অংশ-দায় স্বীকার করা, দুঃখপ্রকাশ করা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।
সেনাবাহিনীর এই দৃষ্টান্ত হোক রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির অংশ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেখিয়ে দিয়েছে-ভুল করলেও সেই ভুলকে ঢাকতে হয় না। বরং দায়িত্বের সঙ্গে তা স্বীকার করলেই মানুষের আস্থা আরও দৃঢ় হয়। এ এক মহানুভবতা ও বিবেকবান নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।
আমরা চাই, প্রশাসন, আইনপ্রণেতা, বিচার বিভাগ-সকলেই এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করুক। তাহলে আমাদের রাষ্ট্র হবে আরও মানবিক, আরও ন্যায়ভিত্তিক, আরও বিশ্বাসযোগ্য।