লন্ডন থেকে রাষ্ট্র বিপ্লবের বার্তা: অধ্যাপক ড. ইউনূস কি তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্জন্মের স্থপতি?

মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
লন্ডন সফরে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যা করলেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। কূটনীতি, আন্তর্জাতিক আইন, অর্থনৈতিক অপরাধ, মানবিক উন্নয়ন ও নৈতিক নেতৃত্ব-এই পাঁচটি ক্ষেত্রেই তিনি এমন এক কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা বাংলাদেশে রাষ্ট্র কাঠামো বদলের সম্ভাবনাকে আরও বাস্তব করে তুলেছে। এই সফর ছিল না কেবল এক নোবেল বিজয়ীর প্রবাস সফর; এটি ছিল রাষ্ট্র শুদ্ধিকরণের এক নীরব কিন্তু বিস্ফোরক ঘোষণা।

পাচার করা অর্থ জব্দের সিদ্ধান্ত: চোরাবাজারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ শুরু

যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট ফিনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স সংস্থাগুলো ও অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের পাচার করা বিপুল পরিমাণ অর্থের ওপর ‘ফ্রিজিং অর্ডার’ জারি করেছে। এর মধ্যে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সম্পত্তি ও বিনিয়োগ সম্পদ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, এসব অর্থের বেশিরভাগ অংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের ঘনিষ্ঠদের সাথে সম্পর্কিত। এই পদক্ষেপের ফলে আওয়ামী লীগ প্রায় অচলাবস্থায়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ড. ইউনূসের সফর এবং তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এই পদক্ষেপে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয়েছে, এখন বিশ্ব নেতৃত্ব বাংলাদেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একজোট হতে শুরু করেছে।

স্যার কিয়ার স্টারমার দেখা করেননি: কারণ কী?

অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, কেন যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি? প্রথমত, এটিকে একধরনের অবহেলা হিসেবে দেখানো হচ্ছিল, কিন্তু পরে একাধিক ব্রিটিশ ও প্রবাসী বাংলাদেশি সূত্রে জানা যায়, এর পেছনে রয়েছে লজ্জাজনক এক বাস্তবতা।

আওয়ামী লীগ বিগত এক দশকে লেবার পার্টির কিছু অংশে নিয়মিত অর্থায়ন করেছে-প্রধানত লন্ডনভিত্তিক কিছু বাঙালি লেবার কাউন্সিলরদের মাধ্যমে। ফলে লেবার পার্টির একটি অংশ অধ্যাপক ইউনূসের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে হুমকি হিসেবে দেখেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এই “পলিটিক্যাল কনফ্লিক্ট” এড়াতে তার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ থেকে বিরত থেকেছে। এটি প্রকারান্তরে প্রমাণ করে-বাংলাদেশি রাজনৈতিক দুর্নীতি কীভাবে বিদেশেও প্রভাব বিস্তার করেছে, এবং কীভাবে একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব সেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

বিএনপি-জাতীয় ঐক্য ও প্রবাসী সমাজের প্রতিক্রিয়া: গঠনমূলক ঐক্যের সম্ভাবনা

অধ্যাপক ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছে বিএনপি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনসহ অসংখ্য সংগঠন। তারা বলছে-এই উদ্যোগ কেবল একজন ব্যক্তির সাফল্য নয়, বরং গণমানুষের দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির সনদ।

যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে ঐক্য ও উৎসাহ। একসময় যারা রাজনীতিকে বিতৃষ্ণার চোখে দেখতেন, তারাও এখন বলছেন, “ড. ইউনূস যদি চান, আমরা তার পাশে থাকব। কারণ তিনি আমাদের দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের আশার প্রতীক।”

কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে এই সফর?
১. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস এখন কেবল নোবেলজয়ী নন, তিনি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের এক প্রতীক। বিশ্ব দেখছে, বাংলাদেশের শুদ্ধিকরণের নেতৃত্ব দিতে তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত।

২. রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ: দেশের মধ্যে কোনো বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব নেই বলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার প্রকৃত উত্তর হতে পারেন অধ্যাপক ইউনূস।

৩. রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার চাহিদা: এই সফর পরিষ্কার করলো-বিদেশেও এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। ড. ইউনূস সেই সেতুবন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠছেন।

জনপ্রত্যাশার শেষ কথা: “অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ” থেকে “স্টেট রিফর্ম”-বিপ্লবের ধারা শুরু হলো!

লন্ডনের এই সফর আমাদের বলে দেয়-শুধু নির্বাচন বা দল নয়, বাংলাদেশ এখন রাষ্ট্রগঠন ও বিচার-নীতি সংস্কারের এক মোড়লগ্নে দাঁড়িয়ে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন কেবল একজন প্রশাসনিক প্রধান উপদেষ্টা নন, তিনি একটি নবজাগরণ-রাষ্ট্রচেতনার প্রতিনিধি। তিনি ‘রাষ্ট্র মানেই ক্ষমতার উৎস’ ধারণাকে ভেঙে দিচ্ছেন। তার জায়গায় আনছেন ‘রাষ্ট্র মানেই জনগণের কল্যাণ’ ধারণা।

এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী?
১. তাকে শুধু অভিনন্দন নয়, জনগণের পক্ষ থেকে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট দেওয়া।
২. রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক সমালোচনার পাশাপাশি সংহতির ডাক দেওয়া।
৩. জনগণকে নতুন রাষ্ট্রচেতনায় উজ্জীবিত করা-একটি দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক, সুবিচারভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য।

আজ সময় এসেছে-আমরা কাকে চাই, তা বলার নয়, দেখানোর। ড. ইউনূস দেখাচ্ছেন। আমাদের দেখা ও এগিয়ে চলার সময় এখন।