মধ্যপ্রাচ্য এখন বিস্ফোরণের মুখে: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া না তো?

বিশ্লেষণমূলক নবজাগরণ ডেস্ক-মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :

বিশ্ব এখন এক উত্তাল দ্বন্দ্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, আর এর পেছনে যার ছায়া দীর্ঘ-সে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্ক টাইমসসহ একাধিক পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের ওপর সরাসরি হামলা চালায়, তবে ইরান পাল্টা আঘাত হানবে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর।

এখন আর প্রশ্ন হচ্ছে না “যুদ্ধ হবে কি হবে না?”-প্রশ্ন হচ্ছে, এই যুদ্ধ কতটা বিস্তৃত হবে? আর কে কোন পক্ষ নিচ্ছে?

ইরানের প্রতিরোধ প্রস্তুতি

ইরান এরই মধ্যে প্রস্তুত করে রেখেছে হাজার হাজার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ মিসাইল, সুসজ্জিত ড্রোনবহর এবং শত শত ‘শহীদ-১৩৬’-এর মতো কামিকাজে ড্রোন। সূত্র জানায়, প্রথম পাল্টা হামলার লক্ষ্য:

ইরাকের আল-আসাদ ঘাঁটি,
বাহরাইনে ইউএস নেভাল বেস,
কাতারের আল-উদেইদ ঘাঁটি,
ইউএই-এর বিমানঘাঁটি ও রাডার ইনস্টলেশন।

ইরান এমনকি ঘোষণা দিয়েছে, যে আরব দেশগুলো তাদের মাটি মার্কিন বাহিনীকে ব্যবহারে দেবে, তারাও ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচিত হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসী প্রস্তুতি

যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে পাঠিয়েছে ৩৬টি রিফুয়েলিং ট্যাংকার বিমান, মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছে স্ট্র্যাটেজিক বোম্বার ও ড্রোন স্কোয়াড্রন। জর্ডান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪০ হাজার মার্কিন সেনা সর্বোচ্চ সতর্কতায় আছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা সামরিক ব্লকের অন্য সদস্যরা:

ব্রিটেন: ভূমধ্যসাগরে রণতরী ও সাবমেরিন মোতায়েন,

ফ্রান্স: গোপনে সৌদি আরবে সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে,

জার্মানি: গোয়েন্দা নজরদারি ও স্যাটেলাইট নজরদারিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এটি একটি সুস্পষ্ট ন্যাটো-মধ্যপ্রাচ্য মিলিত সামরিক চাপ।

চীনের অবস্থান: কূটনৈতিক চুপিসারে কৌশলগত শক্তি

চীন এখনো সরাসরি কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি, কিন্তু এর ভূমিকাই সবচেয়ে কৌশলগত।

তারা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে পুনর্মৈত্রীর মধ্যস্থতাকারী,

যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বারবার জাতিসংঘে “সীমিতকরণ” দাবি করছে,

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: চীন ব্রিকস প্ল্যাটফর্মে ইরানকে অন্তর্ভুক্ত করে পশ্চিমা জোটবিরোধী একটি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বলয় গড়ে তুলছে।

চীনের আসল শক্তি এখন সামরিক নয়-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক রণকৌশলে।

রাশিয়ার অবস্থান: ছায়াযুদ্ধের প্রস্তুতি

ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া এই অঞ্চলে ইরানের প্রধান মিত্র হিসেবে কাজ করছে।

সিরিয়ায় রাশিয়ার উপস্থিতি এখনো শক্তিশালী,
তারা ইরানকে সামরিক ড্রোন প্রযুক্তি দিয়েছে,

গোপনে রাশিয়া-ইরান-চীন সাইবার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সমন্বয় করছে।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ এক ঘোষণায় বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানকে আক্রমণ করে, সেটা রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তাকেও প্রভাবিত করবে।” এই বক্তব্য কোনো কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়-এটি ছায়াযুদ্ধের হুমকি।

উত্তর কোরিয়া: সরাসরি মার্কিনবিরোধী বার্তা

উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘উগ্র সাম্রাজ্যবাদী’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, “ইসরায়েল ও তার সহযোগীরা দমন নীতির মাধ্যমে গোটা মুসলিম বিশ্বকে দাসে পরিণত করতে চায়।”
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি অনেকাংশে ইরানে রপ্তানি হয়েছে, এবং

তারা প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করলে আমরা শুধু দেখেই থাকব না।”

তুরস্ক: দ্বৈতনীতি না বিপ্লবী অবস্থান?
তুরস্কের অবস্থান এখনো দ্ব্যর্থতামূলক।
একদিকে তারা ন্যাটোর সদস্য,
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনপন্থী বক্তব্য দিচ্ছেন।

তুরস্ক গোপনে ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, হাইফা বন্দর ব্যবহার স্থগিত এবং ইরানকে তথ্য সহায়তা দিচ্ছে বলে গুঞ্জন আছে। যদিও প্রকাশ্যে তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না, তবুও তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে একটা তৃতীয় শক্তির অবস্থান তৈরি করছে-যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের দাবি রাখতে পারে।

যুদ্ধের ভবিষ্যৎ মানচিত্র: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া?

এই যুদ্ধ আর মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই।
এটি হয়ে উঠছে:

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল বনাম চীন-রাশিয়া-ইরান-উত্তর কোরিয়া জোটের গ্লোবাল প্রতিযোগিতা,

একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা (multipolar world) গঠনের রক্তাক্ত যুদ্ধ।

এই যুদ্ধের পরিণতি হতে পারে:
বৈশ্বিক মুদ্রা বিপর্যয়,
জ্বালানি ও খাদ্য সংকট,
মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক ভূমিকম্প,
পশ্চিমা আধিপত্যের অবসান এবং নতুন প্রতিরোধভিত্তিক বিশ্ব বাস্তবতা।

ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মুসলিম বিশ্ব

এটা আর কেবল ফিলিস্তিনের যুদ্ধ নয়। এটা বিশ্বশক্তির কেন্দ্রের স্থানান্তর যুদ্ধ।
ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র চায় বিশ্ব একমেরুতে চলুক। আর চীন-রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক চাইছে এক নতুন সাম্যবাদী-আঞ্চলিক শক্তিসমতা।

আজকের গাজা, কালকের রিয়াদ, পরশুর ওয়াশিংটন?
এই প্রশ্ন এখন কল্পনা নয়-সম্ভাব্য বাস্তবতা।