নবজাগরণ ডেস্ক:
পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু দিন থাকে, যেসব দিন ক্যালেন্ডারে শুধু সংখ্যা নয়-বরং একটি জাতির বিবেকের শপথ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তেমনি বাংলাদেশে একটি দিন দিন দিন ক্রমশই প্রতীকে রূপ নিচ্ছে-৫ আগস্ট।
এটি শুধু একটি আন্দোলনের দিন নয়, এটি সেই মুহূর্ত-যখন রাজপথে সাধারণ ছাত্র-জনতা রাষ্ট্রীয় মেশিনারির ভয়াল থাবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বুক পেতে। গর্জে উঠেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় পিশাচদের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে।
২০১৮ সালের ৫ আগস্ট:
এই দিনটি ছিল ছাত্র-জনতার কণ্ঠরোধের শেষ দমন-পীড়নের শুরু।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি ছাত্রদের আন্দোলন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় নির্মমভাবে দমন করা হয়।
টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, রামদা, লাঠি, রড দিয়ে হামলা চালানো হয় স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরা শিশু-কিশোরদের উপর।
সাংবাদিকদের উপর হামলা, শিক্ষার্থীদের উপর যৌন সহিংসতা, ছাত্রনেতাদের গুম-হুমকি চালানো হয়।
ধরা পড়ে সেই ভয়াবহ সত্য-এই রাষ্ট্র মানুষের নয়, এই রাষ্ট্র কেবল ক্ষমতাবানদের।
কেন ৫ আগস্ট ‘গণঅভ্যুত্থান দিবস’?
১. কারণ এটি একটি ‘স্পার্ক’ ছিল:
২. ৫ আগস্টের দমন-পীড়ন বুঝিয়ে দিয়েছিল, রাষ্ট্র শুধুই বন্দুক নয়-রাষ্ট্র হল জনতার যৌক্তিক রোষের মুখোমুখি দাঁড়ানো এক দানব।
এই দিন আন্দোলনের বিরুদ্ধে নয়, পুরো তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ক্ষমতা।
৩. কারণ এটি প্রতিরোধের প্রতীক:
এই দিন মেয়েদের হোস্টেল ঘেরাও করে পেটানো হয়, সাংবাদিকের ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়, নামধারী ছাত্রলীগ খোলা রাস্তায় শিশুদের রক্তাক্ত করে।
তবু, ভীত হয়নি ছাত্রসমাজ। ব্যারিকেড দিয়েও থামানো যায়নি তাদের কণ্ঠস্বর। এটাই গণঅভ্যুত্থান নয় তো কী?
৪. কারণ রাষ্ট্র ধসে পড়েছিল নৈতিকতাহীনতায়:
সে দিন ‘শিশুরা আন্দোলন করবে না’ এমন একটি জঘন্য মতবাদ সামনে এনে সরকার নিজেকে ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে প্রকাশ করে।
কোনো সরকার যদি তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ন্যায্য দাবি রক্তে চেপে রাখে-তাহলে সেই সরকার কেবল অবৈধ নয়, তা পতনের প্রহর গোনে।
ইতিহাসের আয়নায় আমরা একা নই:
১৯৬৯ সালে ১১ দফা ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান হয়ে উঠেছিল।
১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ছাত্রদের রাজপথে নামার মাধ্যমেই।
২০১৮ সালের আন্দোলন সেই ধারারই আধুনিক প্রকাশ-তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সংগঠিত, সামাজিক সচেতনতা দ্বারা চালিত।
তাই দাবি একটাই:
৫ আগস্টকে “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দিবস” হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
যদি রাষ্ট্র স্বীকৃতি না দেয়, তবে জনগণ দিবস প্রতিষ্ঠা করবে। কারণ, ইতিহাস যখন রাষ্ট্রের হাতে ধ্বংস হয়, তখন তা গড়ে তোলে জনতা।
এই আন্দোলনের শিক্ষা:
১. রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র ছাত্র-জনতার ঐক্য।
২. নিরাপদ সড়ক’ নয়, ‘নিরাপদ রাষ্ট্র’-এর দাবিতে এখন নতুন প্রজন্ম জাগছে।
৩. শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তোলার আহ্বানও এই দিন থেকে শুরু হয়েছে।
৫ আগস্ট হোক প্রতিরোধের দিবস।
হোক স্মৃতির দিন-যে দিনে শহর রক্তাক্ত হয়েছিল, কিন্তু তরুণ হৃদয় ভাঙেনি।
এই দিন ইতিহাসে লেখা থাকবে-যারা শিশুদের রক্তে রাজপথ রাঙিয়েছে, তারা একদিন পতনের ঘন্টাধ্বনি শুনবে ছাত্র-জনতার কণ্ঠ থেকে।★★
৫ আগস্ট: আমাদের লাল সূর্য
নবজাগরণ-কবিতা বিভাগ :
রক্তে ভেজা সড়কের ধারে,
চোখে স্বপ্ন, বুকের মাঝে আগুন জ্বলে।
স্কুল ড্রেসে শিশুরা রণে নামে,
পেনসিল ছেড়ে হাতে নেয় শ্লোগানের তলোয়ার।
বলেছিলাম, নিরাপদ সড়ক চাই,
তারা পাঠাল কাঁদানে গ্যাস, লাঠির ঝড়।
আমরা থামিনি, কাঁদিনি-
স্লোগান দিয়ে ঢেকে দিয়েছি চোখের জল।
৫ আগস্ট, তুমি আর শুধু একটি তারিখ নও,
তুমি রাজপথের বিদ্রোহী মঞ্চ,
তুমি ভয়হীন চেহারা, ভাঙা চশমা,
তুমি পতাকা-যে উড়েছিল পুলিশের বুটের মুখে।
তুমি সেই মেয়েটি-
যার চুল টেনে টেনে ছিঁড়েছিল কাপুরুষ খুনিরা।
তুমি সেই ছেলেটি-
যার ফোন কেড়ে নিয়েছিল সশস্ত্র দালালেরা।
তুমি রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে ধরা শিশুর হাত,
তুমি জনতার জেগে ওঠা চেতনার প্রভাত।
তুমি ভয়ার্ত চোখে আগুনের আলো,
তুমি বলেছিলে-“আমরা ছাত্র, আমরা ভয় পাই না!”
তাই আজ বলি-
৫ আগস্ট হোক আমাদের দিবস,
একটি গণঅভ্যুত্থানের দৃপ্ত নিশান।
শাসকের রক্তচক্ষু ভেদ করে বলি,
“আমরা ছিলাম, আছি, থাকব-পথের দাবিদার!”
গ্রন্থনা:আবু তাহের পাটোয়ারী।