মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
২৩ জুন২০২৫
একটি জাতির চেতনায় যদি অন্য জাতির মৃত্যু ঘটে, তবে সেই রাষ্ট্রের জন্মকেই কি বৈধতা দেওয়া যায়? আজকের ইসরায়েল রাষ্ট্র শুধুমাত্র ভূখণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এটি গড়ে উঠেছে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনির বুকের রক্ত, ঘরছাড়া মানুষের কান্না আর ইতিহাসের নির্মম প্রতারণার উপর দাঁড়িয়ে। এই রাষ্ট্রের পেছনে শুধু ইহুদিবাদ নয়, ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক গণপ্রপাগান্ডা, এবং ছিল আরব দেশগুলোর নতজানু নেতৃত্বের সম্মতি। আজ, যখন গাজার আকাশে আগুন, তখন জরুরি হয়ে পড়ে জানতে-কারা এই দানব রাষ্ট্রের নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল?
ইহুদি রাষ্ট্রের রূপরেখা : ইউরোপীয় দোষ ঢাকার এক প্রতিস্থাপন পরিকল্পনা
ইউরোপে শত শত বছর ধরে ইহুদিদের উপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে, কিন্তু সেই দায় নিজের মাটিতে মেটাতে রাজি হয়নি পশ্চিমারা। বরং এক অদ্ভুত কৌশলে, এই দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় আরবদের ঘাড়ে। এই পরিকল্পনার নাম হয় জায়োনিজম-এক রাজনৈতিক মতবাদ, যার দাবি, প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’। অথচ সে ভূখণ্ডে তখনও শতকরা ৯০ ভাগ ছিল মুসলিম ও খ্রিস্টান ফিলিস্তিনি।
১৯১৭ সালের ‘ব্যালফোর ঘোষণা’ ছিল এক কথায় ঔপনিবেশিক ঘোষণাপত্র-যেখানে ব্রিটিশ সরকার, প্যালেস্টাইনকে উপহার দেয় এমন এক জাতিকে, যার সেখানে বসবাসের কোনও আইনগত অধিকার ছিল না। আর এই উপহারের বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের জোটভাঙা, দমন এবং বিতাড়নের শেকড় গেঁথে দেওয়া হয় ইতিহাসে।
জাতিসংঘ ও পশ্চিমা গণতন্ত্রের স্বরূপ
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের পাস করা Partition Plan ছিল ইতিহাসের আরেক কালো অধ্যায়। কোনো গণভোট ছাড়াই, কোনো স্থানীয় সম্মতি ছাড়াই, ফিলিস্তিনকে ভাগ করা হয় ‘ইহুদি’ ও ‘আরব’ রাষ্ট্রে। অথচ তখনকার ফিলিস্তিনে মাত্র ৩৩% ইহুদি ছিল-যাদের অধিকাংশই সদ্য আগত ইউরোপীয় অভিবাসী। তারপরও তাদের দেয়া হয় ৫৬% জমি! ফিলিস্তিনিদের চোখের সামনে তাদের নিজ ভূমি হয়ে যায় পরধর্মের স্বপ্নরাজ্য।
এটিই সেই জালিয়াতির মঞ্চ, যেখান থেকে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলের রাষ্ট্রঘোষণা। পরদিনই শুরু হয় যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঘটে আন-নাকবা-৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে গড়ে তোলা হয় এক জাতিগোষ্ঠীকেন্দ্রিক সশস্ত্র কৃত্রিম রাষ্ট্র। এই দিনটি ছিল জাতিসংঘ ও গণতন্ত্রের মুখোশ খোলার দিন।
কাদের স্বার্থে গড়া হলো ইসরায়েল?
ইসরায়েল গঠনের পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল কেবল জায়োনিস্ট নেতারা নয়। এখানে ছিল ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বশাসনের ছক এবং পরবর্তীতে আরব রাজতন্ত্রগুলোর নির্লজ্জ সমর্থন।
যুক্তরাষ্ট্র: মাত্র ১১ মিনিটে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বকে জানান দেয়, এটাই তাদের মধ্যপ্রাচ্যের স্ট্র্যাটেজিক “অ্যাডভান্সড পোস্ট”। আজও তারা ইসরায়েলের অস্ত্র, যুদ্ধ এবং হত্যা অভিযানে সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক।
সোভিয়েত ইউনিয়ন: অবাক করা হলেও সত্য, কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৪৮ সালে। চেকোস্লোভাকিয়া অস্ত্র পর্যন্ত সরবরাহ করে।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো: ফ্রান্স, পোল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাজ্য-যারা ইহুদিদের নির্যাতন করেছিল তারাই আবার ইসরায়েলের জন্মের ‘অভিভাবক’ হলো। পাপ ঢাকার জন্য অন্যের ঘাড়ে দেশ চাপিয়ে দেওয়া হল!
আরব জগৎ: স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ
ইসরায়েলকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় মিশর (১৯৭৯), এরপর জর্ডান (১৯৯৪)। দীর্ঘ সময় পরে আব্রাহাম অ্যাকর্ডস-এর মধ্য দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান যুক্ত হয় এই লজ্জার তালিকায়। স্বীকৃতির বিনিময়ে মেলে অস্ত্র, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি-মানবতার নয়।
বিশেষত সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো এখন এক ইরান-বিরোধী জোটে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসরায়েল হয়ে উঠেছে তাদের ‘গোপন বন্ধু’। অথচ এই স্বীকৃতি আরব জনগণের মন জিততে পারেনি। বরং আজও তিউনিসিয়া থেকে কায়রো, রিয়াদ থেকে জাকার্তা পর্যন্ত জনসাধারণ ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য স্লোগান দেয়।
মোসাদ: আধুনিক যুগের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের প্রতীক
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ আজ এক ছায়াসম মৃত্যুদূত। বিশ্বজুড়ে হামাস, ইসলামিক জিহাদ, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ নেতাদের গোপনে হত্যা করে চলেছে তারা-ড্রোন, বিষ, সাইবার হামলা, দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র-সবই মোসাদের হিন্দসা কৌশল।
টিউনিসিয়া, দুবাই, তেহরান-যেখানেই ফিলিস্তিনের পক্ষে কেউ দাঁড়িয়েছে, সেখানেই মৃত্যু এসেছে ছায়ার মতো। অথচ জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো কেবল “উদ্বেগ প্রকাশ” করেই দায় সারছে।
একটি প্রশ্নের মুখোমুখি বিশ্ব বিবেক?
আজ ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এক প্রতিরোধের নাম। গাজা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দমে যাচ্ছে না। ফিলিস্তিনিরা আজও প্রশ্ন তোলে-ইসরায়েল রাষ্ট্র কি আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ? নাকি একটি ঔপনিবেশিক বলপ্রয়োগের কুৎসিত বাস্তবতা?
ইসরায়েলের স্বীকৃতি মানে কি গণহত্যার বৈধতা দেওয়া? জমি দখলের ছাড়পত্র দেওয়া? বাচ্চা হত্যা, ত্রাণবাহী ট্রাক ধ্বংস আর হাসপাতাল ধ্বংসের লাইসেন্স দেওয়া?
শেষ কথা: ইসরায়েল একটি রাষ্ট্র নয়, একটি সাম্রাজ্যবাদী প্রজেক্ট
ইসরায়েল রাষ্ট্র নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদের ‘মধ্যপ্রাচ্য শাখা’। এটি একটি অস্ত্র-প্রযুক্তি-গোয়েন্দা ল্যাব, যেখান থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোকে ঘায়েল করার নীলনকশা বের হয়। ফিলিস্তিনিদের ত্যাগ, তেহরানের প্রতিরোধ এবং জনগণের চেতনা এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইতিহাসের এক অমোচনীয় লেখা রচনা করছে।
আজ প্রয়োজন সেই চেতনার একাত্মতা। কারণ ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে গোটা মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। আর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি মানে নিজেরই ভবিষ্যতের স্বাধীনতা।