ইসরায়েলি দানবের মুখে লাথি: ড. এরবাকানের বিপ্লবী নকশা

অনুবাদ ও পুনর্গঠন: বুরহান উদ্দিন আজাদ

“তারা ষড়যন্ত্র করেছিল-যাতে পাহাড়ও নড়ত, কিন্তু আল্লাহর কাছে ছিল তাদের ষড়যন্ত্রের জবাব।”
-সূরা ইবরাহিম: ৪৬

আজ যখন গাজার রক্তস্রোত বিশ্ববিবেককে লজ্জায় ফেলে দেয়, যখন মুসলিম রাষ্ট্রনায়করা সম্মেলনের টেবিলে ‘দুঃখ’ জানিয়ে কফির চুমুক দেন, তখন এক দুর্লভ স্মৃতি স্মরণে আসে-তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান।

২০০৯ সালে ইরানে তাঁর ঐতিহাসিক সফরে দেওয়া একটি ভাষণ ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা এক দিকনির্দেশনা। তাঁর বক্তৃতা ছিল শুধু আবেগভরা প্রতিবাদ নয়-ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি, এক বিপ্লবী নকশা।

❖ যায়নবাদ-এক মহাদানব, এক চক্রব্যূহ

এরবাকান বলেন, আমরা ভুল করে ইসরায়েল বা ইহুদি জাতিকে “Zionism” হিসেবে ধরে নিই। কিন্তু এই যায়নবাদ হলো এক বিশাল কুমির—এর উপরের চোয়াল আমেরিকা, নিচেরটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দাঁত আর জিহ্বা হলো ইসরায়েল। আর গলা-পেট-শরীর? মুসলিম বিশ্বের দালাল শাসকরা, কর্পোরেট মিডিয়া, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী আর তথাকথিত মানবতাবাদী সংগঠনগুলো।

এই কুমির এখন বিশ্ব শান্তিকে গিলে ফেলছে। গাজায় শিশুরা নিহত হচ্ছে, বোমায় স্কুল-হাসপাতাল উড়ছে-এবং ওদিকে যায়নবাদ তাদের “আকিদা” পূরণে ব্যস্ত। কারণ এরবাকানের ভাষায়-Great Middle East Project শুধু একটি রাজনীতিক চক্রান্ত নয়, এটি যায়নবাদীদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ।

ইসরায়েলের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রী বলেন-“আমাদের দুটি মানচিত্র আছে: একটি দেওয়ালে টানানো, অপরটি আমাদের অন্তরে খচিত।”

❖ সম্মেলন-ভাষণ নয়, দরকার পদক্ষেপ

এরবাকান ব্যঙ্গ করে বলেন-“OIC আর মুসলিম বিশ্ব শুধু সেমিনার করে, সেখান থেকে এক ‘জরুরি আহ্বান’ বের করে: ‘ইরাক থেকে আমেরিকা প্রত্যাহার হোক।’” অথচ ওয়াশিংটনে রকফেলাররা কফির কাপে চুমুক দিয়ে হাসে-কারণ মুসলিমরা ‘বক্তব্য’ দেয়, আর পশ্চিমা চক্র ‘পদক্ষেপ’ নেয়।

❖ নিজের অভিজ্ঞতা: ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে

১৯৯৬ সালে এরবাকান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হন। প্রথম দিনেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছয়টি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে হাজির:

১. ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য ৫০ মিলিয়নের বেশি নয়
২. ইরান সফর নয়
৩. মুসলিম দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক মৈত্রী নয়
৪. তুরস্কে পশ্চিমা এনজিও নিয়ন্ত্রণ নয়
৫. মার্কিন ঘাঁটি বন্ধ নয়
৬. ইরাকি পাইপলাইন নিয়ন্ত্রণ নয়

এরবাকান উল্টো পথ ধরেন-ইরানের সাথে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের গ্যাসচুক্তি করেন। D-8 গঠন করেন, মুসলিম বিশ্বের কমন মার্কেট প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটেন।

এর ফল কী হয়? মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ও আঙ্কারার ইহুদি রাষ্ট্রদূত ক্রসম্যান সিদ্ধান্ত নেন-“এরবাকানকে ক্ষমতা থেকে সরাতেই হবে।” এবং ইতিহাস জানে-তাঁকে সরানো হয়েছিল।

❖ প্রযুক্তি বনাম সাম্রাজ্যবাদ: নতুন দুনিয়ার সংকেত

ড. এরবাকান বিশ্বাস করতেন, আমরা অস্ত্রের দৌড়ে পশ্চিমকে হারাতে পারব না। কারণ তারা ৪০টি যুদ্ধজাহাজ থাকলে ৮০টি বানাবে, আমাদের প্রতিক্রিয়ায়।

তাই সমাধান-“প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তি”।
তিনি বলেছিলেন:

“আমরা এমন প্রযুক্তি বানাব, যাতে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ঘুরে তাদের ঘাঁটিতেই আঘাত হানে। ইলেকট্রিক্যাল-ইলেকট্রনিক্সে এর প্রোটোটাইপ আমি নিজে তৈরি করেছি।”

তিনি বলেছিলেন-ওজনহীন বিমান বানাতে হবে, যেটি তেহরান থেকে চালানো যাবে, আর আঘাত করবে তেলআবিবে।

এই সবই তাঁর কাছে ছিল অলীক কল্পনা নয়-নকশা ও প্রয়োগের বিষয়।

❖ নতুন বিশ্বব্যবস্থা: D-8 থেকে D-60

এরবাকান বলেছিলেন, D-8 (৮ মুসলিম দেশ) হবে বীজ, তার চারপাশে D-60 (ষাটটি নিপীড়িত দেশ)। এরপর এর সংহতি গড়তে হবে চীন, রাশিয়া, ভারত, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা সহ ৬০০ কোটি মানুষকে নিয়ে।

তিনি চান ইসলামি দিনার চালু হোক কমন মুদ্রা হিসেবে, ইসলামি ন্যাটো গঠিত হোক নিরাপত্তার জন্য, এবং একটি বিকল্প জাতিসংঘ গঠিত হোক।

“আমরা নতুন এক দুনিয়া গড়ব, যেখানে ইসলামই হবে শান্তির কেন্দ্র। কারণ ইসলাম ছাড়া বিশ্বে শান্তি অসম্ভব।”

❖ শেষ কথা: উত্তরাধিকার ও নির্দেশনা

আজ যখন গাজার শিশুদের লাশ পৃথিবীর বিবেক ঝাঁকিয়ে দেয়, আমাদের মনে রাখতে হবে-ড. এরবাকান ছিলেন কেবল একজন নেতা নন, তিনি ছিলেন একজন দিক-নির্দেশক। তিনি দেখিয়ে গেছেন-কিভাবে পরিকল্পনা, আত্মবিশ্বাস ও ঈমান দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ভেঙে দেওয়া যায়।

“তারা চক্রান্ত করে, কিন্তু আল্লাহর কাছে সেই চক্রান্তের জবাব থাকে-যা পাহাড়ও টলিয়ে দেয়।”
(সূরা ইবরাহিম: ৪৬)

আজ যারা প্রতিরোধে আছেন-ইরানে, গাজায়, কাতারে, লেবাননে—তারা যেন এই বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির উত্তরাধিকার বহন করেন।

“আমরা হারিনি-আমরা বীজ বপন করেছি।”-
প্রফেসর ড. নাজিমুদ্দিন এরবাকান
প্রকাশনায় :নবজাগরণ-
শেয়ার করুন সবাই। www.thenabajagaran.com