নবজাগরণ ডেস্ক-২৭ জুন ২০২৫
একটা মেয়ের গল্প, যার বাবা নেই। মা স্ট্রোক করেছেন-হঠাৎ, ঠিক পরীক্ষার দিন সকালে। আশেপাশে কেউ নেই, বাড়ি ফাঁকা। তার সামনেই পড়ে আছে দুইটা দায়-একদিকে হাসপাতাল, আরেকদিকে পরীক্ষা। সে বেছে নেয়, প্রথমে মাকে বাঁচানো। এরপরেই ছুটে যায় পরীক্ষাকেন্দ্রে। দেরি হয়ে গেছে, স্বাভাবিক। পরীক্ষা দিতে পারলো না।
এই মেয়েটির নাম আনিসা আহমেদ। এইচএসসি পরীক্ষার্থী। কলেজের নাম-ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ। গতকাল সকালের এই ঘটনা বিকেলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়েই যেন উন্মোচিত হলো এক সমাজের-ব্যর্থতা, দায়িত্বশীলতা ও সম্ভাবনার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
মানবতা এখনও নিভে যায়নি
আনিসার পাশে দাঁড়িয়েছেন বহু মানুষ। ফেসবুকে অসংখ্য পোস্ট, শেয়ার, মন্তব্য-সব একটাই বলছে: এই মেয়ে যেন পরীক্ষা দিতে পারে। কেউ লিখেছেন, “এটাই জীবনের বড় পরীক্ষা, আর আনিসা তাতে পাশ করে গেছে।”
এরই মাঝে এগিয়ে আসেন একজন আইনজীবী, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, যিনি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি নিজে থেকে বিনা পারিশ্রমিকে আনিসার আইনি সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তিনি উল্লেখ করেন ২০০০ সালে মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক নজির, যেখানে অনুরূপ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মিস হওয়া পরীক্ষা পুনরায় গ্রহণ করা হয়েছিল।
ব্যারিস্টার কাজল জানান,
“আমি আনিসার মা ও অধ্যক্ষ স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টার দৃষ্টিতে আনা হয়েছে। আমি আশাবাদী, মানবিক বিবেচনায় আনিসার পরীক্ষাটি নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।”
মানবিক রাষ্ট্র ও অনাদায়ী দায়িত্ব
ঘটনাটি পৌঁছেছে সরকারের সর্বোচ্চ মহলেও। শিক্ষা উপদেষ্টা নিজেও বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। এমন মানবিক ও দ্রুতসন্ধানী প্রতিক্রিয়া প্রশংসার দাবিদার। তবে প্রশ্ন জাগে, এমন একটি ঘটনায়, যেখানে মেয়েটি পরীক্ষার সময় মিস করেছে হাসপাতাল নিয়ে ছুটোছুটি করতে গিয়ে-সেখানে কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষা বোর্ড তাৎক্ষণিকভাবে মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না?
একটি রাষ্ট্র কেবল আইন বা নীতিমালার সংকলন নয়; রাষ্ট্র আসলে মানুষের, মানুষের জন্য, মানুষের দ্বারা। আনিসার ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়-আমরা যখন চাই, তখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও মানবিক করে তুলতে পারি।
এ ঘটনায় সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দিকটি ছিল কিছু তথাকথিত গণমাধ্যমকর্মীর আচরণ। আনিসা যখন কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল থেকে কেন্দ্রে এসেছিল, তখন তাকে ক্যামেরা ঘিরে ধরেছিল কিছু লোক। সে বারবার বলছিল, “প্লিজ ভিডিও করবেন না”-কিন্তু তারা করছিল।এখানে তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি জড়িত এগুলো কী সাংবাদিকতা?
সাংবাদিকতা মানুষের কষ্টকে বাণিজ্যে পরিণত করার নাম নয়। যারা মানবিকতা ভুলে শুধু ‘ভিউ’ আর ‘রেটিং’-এর পেছনে ছুটেন, তারা সমাজের ক্ষত তৈরি করেন, সেবা নয়। এমন সময় আমাদের ভাবতে হয়-সাংবাদিকতা কী আদৌ দায়িত্বশীল হাতেই আছে?
একটি বার্তা- আশার আলো এখনও জ্বলে
আমরা যখন দেখি ব্যারিস্টার কাজলের মতো মানুষ বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে আসেন, যখন দেখি শিক্ষক, সাধারণ মানুষ সবাই একজন পরীক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ান, তখন বুঝি-আশা এখনও মরে যায়নি। শিক্ষা কেবল পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ নয়, জীবনও শিক্ষা দেয়। আর আনিসা সেই শিক্ষার জীবন্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আনিসা একা নয়-
এই মেয়েটি শুধু আনিসা নয়, সে প্রতীক-আমাদের সমাজে শত শত এমন শিক্ষার্থীর, যারা প্রতিদিন জীবনের সাথে যুদ্ধ করে স্কুলে যায়, বই পড়ে, স্বপ্ন দেখে। রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষক ও গণমাধ্যম-সবাই মিলে যদি সেই স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখার কাজটা করি, তবে তবেই জাতি হিসেবে আমরা এগোতে পারি।
আনিসার জন্য দোয়া রইল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বোর্ডের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, মানবিক বিবেচনায় সে যেন পুনরায় পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পায়। সেটাই হবে এই যুগের সবচেয়ে বাস্তব পাঠ।