—মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
১৯৭১ সালে এই দেশ জন্ম নিয়েছিল লক্ষ প্রাণের রক্ত, মা-বোনের সম্ভ্রম আর আগুনঝরা এক অঙ্গীকারের বিনিময়ে-স্বাধীনতা। কিন্তু আজ পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে প্রশ্ন উঠে: এ কী সেই স্বাধীনতা? কোথায় সেই মুক্তির সুফল? কেন আজও আমরা ধর্ষিত, নিপীড়িত, লুণ্ঠিত? স্বাধীনতা মানে কি কেবল পতাকা ওড়ানো আর ২৬ মার্চে ফুল দেওয়া?
একটি ব্যর্থ শাসন কাঠামোর জর্জরিত বাস্তবতা:
আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা মানে চাঁদাবাজির লাইসেন্স, দুর্নীতির সনদ আর প্রশাসনিক দখলের বৈধ অনুমতি হিসেবে দেখে। জনগণের রক্তে কেনা এই রাষ্ট্রব্যবস্থা রাজনৈতিক দলের মঞ্চে পরিণত হয়েছে “নেতা তৈরির কারখানা” হিসেবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হয়ে ঢুকে, ছাত্রনেতা হয়ে উঠে-এরপর আর কোনো পেশার প্রয়োজন পড়ে না। চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণা, বিজ্ঞান-সব বাদ। দরকার শুধু একটা পদ, একটা ‘প্যার্টি ব্যাকিং’, তারপর শুরু হয় তোলা তোলার রাজনীতি, পদ দখলের লড়াই।
সারাদেশে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, জেলা থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দলীয় নিয়োগ আর ভাগাভাগি রাজনীতি চলে। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, কমিশন, মাদক ব্যবসা-সবকিছুর শেকড় আজ রাজনৈতিক দলে। দলের পদ মানেই সুবিধাভোগের অধিকার।
যে রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলো মুক্তিকামী মানুষ, তা আজ চাঁদাবাজদের ক্লাবে রূপান্তরিত
একটা দেশের সবচেয়ে মেধাবী ও সাহসী মানুষদের আসার কথা ছিল প্রশাসন, গবেষণা, চিকিৎসা ও প্রযুক্তি খাতে। অথচ আজ প্রকৃত বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, চিকিৎসা ক্ষেত্রে উদ্ভাবন নেই, শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয় ক্যাডার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে, মেধাবীরা পাসপোর্টের লাইনে, গন্তব্য কানাডা-অস্ট্রেলিয়া।
একটি জাতির মূল শক্তি হয় তার জ্ঞানসম্পদ, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও মানবসম্পদ। কিন্তু বাংলাদেশে এই শক্তিগুলোকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির কাছে বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা স্রেফ গৃহপালিত নেতা হতে পারেনি, তাদের ভাগ্য নির্বাসিত। ক্ষমতা আজ জনগণের হাতে নয়, বন্দী কিছু পরিবারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের হাতে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যর্থতা?
বাংলাদেশের পর যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, যেমন ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, এমনকি রুয়ান্ডা-তারা আজ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও শিল্প খাতে তারা সাফল্য দেখিয়েছে। অথচ আমরা এখনো বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, সড়ক, খাদ্যশস্য এমনকি স্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে হাহাকার করি।
একটা রাষ্ট্রের নাগরিক যদি নিরাপত্তা, শিক্ষা, ন্যায্য বিচার ও কর্মসংস্থান না পায়, তবে সে রাষ্ট্র কীভাবে ‘সফল’ হতে পারে? যখন রাষ্ট্র তার সবচেয়ে মেধাবীদের বিদেশে পাঠায়, আর দেশে রেখে দেয় খালি বুলিবাজি করা ‘নেতা’-তখন বুঝে নিতে হবে, রাষ্ট্র তার ভারসাম্য হারিয়েছে।
সমাধানের পথ কোথায়?
১. দলীয় রাজনীতির অপসংস্কৃতির অবসান জরুরি।
২.মেধানির্ভর নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
৩. দলীয় পদাধিকার নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
৪. রাজনৈতিক অপরাধকে রাষ্ট্রীয় শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৫. ‘চাঁদাবাজ নেতা উৎপাদন কারখানা’ বন্ধ করতে হবে।
৬. স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
একটি নতুন গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজন!
এদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি নতুন জাতিগঠনের উদ্যোগের ওপর-যেখানে মানুষ আগে, দল পরে। যেখানে চাঁদাবাজ নেতাদের পরিবর্তে রাষ্ট্র নেতৃত্ব দেবে গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, শিল্পোদ্যোক্তারা। স্বাধীনতা মানে শুধু শত্রুমুক্ত হওয়া নয়-মানুষের অধিকার, সম্মান, কর্মসংস্থান, বিচার ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই স্বাধীনতার চূড়ান্ত অর্জন।
নির্বিশেষে জনস্বার্থে কথা বলার সময় এসেছে সকল দেশপ্রেমিকের:
যে জাতি প্রতিদিন নেতার নামে মিছিল করে, সে জাতি নিজের অধিকার কখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক কোলাহল নয়, এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক প্রতিশ্রুতি। সময় এসেছে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার। একবার নয়, এবার সত্যিকারের বিপ্লব চাই-নেতানির্ভর নয়, জননির্ভর রাষ্ট্র চাই।
লেখক:সম্পাদক ও প্রকাশক
নবজাগরণ।
সবাই শেয়ার করুন –
বিস্তারিত জানতে পড়ুন : www.thenabajagaran.com