রাজাকার: ইতিহাসের বিকৃতি, পরিচয়ের প্রতারণা, জাতির বিশ্বাসঘাতকতা

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
“রাজাকার”-শব্দটি শুনলেই আজও বুক কেঁপে ওঠে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী, গণহত্যার অংশীদার, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সহযোদ্ধা সেই বিশ্বাসঘাতকদের নাম রাজাকার।
কিন্তু প্রশ্ন হলো-কোন ধর্মের পরিচয়ে? কার আদর্শে? কার পোশাকে? কার মুখভঙ্গিতে তারা এসেছিল? আর তাদের অপকর্মের দায় কি গোটা মুসলমান সমাজের ঘাড়ে চাপানো চলে?

রাজাকার: একটি সামরিক শব্দ, ধর্মীয় নয়!
রাজাকার শব্দটি এসেছে ফারসি/উর্দু ‘Razakar’ থেকে-অর্থ: স্বেচ্ছাসেবক।
১৯৪৮ সালে ভারতীয় হায়দরাবাদে মুসলিম রাজা নিজাম-এর বাহিনী গঠন করেছিল প্রথম “রাজাকার বাহিনী”-যারা ভারতের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে ধ্বংস হয়।

১৯৭১ সালের ২ মে, পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নতুন রাজাকার বাহিনী গঠন করে।
এই বাহিনী ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, পীর ও খানকাভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং কিছু ভূস্বামী ও পাকিস্তানপন্থীদের সমন্বয়ে গঠিত।
তাদের লক্ষ্য ছিল:

মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান চিহ্নিত করা
সংখ্যালঘু ও মুক্তিকামী মানুষদের ধরিয়ে দেওয়া
নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া
দখলদার পাকিস্তানিদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে “সার্বভৌম বাংলাদেশ” নির্মাণ প্রতিহত করা

এই বাহিনী কোনো ধর্মীয় সংস্থা নয়, এটি ছিল সামরিক ও রাজনৈতিক জোটের অংশ।

সংখ্যা ও বয়স বিশ্লেষণ:
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার সদস্য ছিল।
অধিকাংশের বয়স ছিল ২০ থেকে ৪৫ বছর।

অনেকে ছাত্র, কেউ-কেউ সরকারি কর্মচারী, অনেকে মসজিদের খাদেম বা ওজুখানা রক্ষক।
তবে সবাই দাড়িওয়ালা, টুপি পরা, সুরমা লাগানো ছিল না।
অনেকে ক্লিন শেভ, প্যান্ট-শার্ট পরা, এমনকি পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত শহুরে লোকও ছিল।
“পাঞ্জাবি, দাড়ি, টুপি = রাজাকার” : এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্র

বিস্ময়করভাবে, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে একটি প্রচারণা চালানো হলো-“দাড়ি, টুপি, গায়ের পাঞ্জাবি, গালে সুরমা মানেই রাজাকার”।
তাহলে কি,

দাড়িওয়ালা হানিফ মুক্তিযোদ্ধা নয়?
মাওলানা ভাসানী দেশপ্রেমিক ছিলেন না?
চট্টগ্রামের সূফি-তরিকতের নেতা যারা মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিলেন, তারাও রাজাকার?

এই প্রচারণা চালিয়েছে:
১. ইসলামবিদ্বেষী এক শ্রেণির বাম-প্রগতিশীল লেখক ও মিডিয়াকর্মী
২. সেক্যুলারিজমের নামে ইসলামকে টার্গেট করা কিছু রাজনৈতিক গ্রুপ
৩. আন্তর্জাতিক এজেন্ডাবাজ মিডিয়া, যারা মুসলমানদের “সন্ত্রাসী” হিসেবে উপস্থাপন করে বিশ্বব্যাপী ফায়দা লুটে

বিচার না হলে ইতিহাস বিকৃত হয়
১৯৭২ সালে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ‘রাজাকার’দের বিচার শুরু হয়, তবে রাজনৈতিক আপসের কারণে তা থেমে যায়।
পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে বটে, কিন্তু-

অধিকাংশ রাজাকার আজও অপ্রকাশিত, অবিচারিত, সমাজে প্রভাবশালী
অনেকেই পুনর্বাসিত, কেউ এমপি, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ স্কুল-কলেজের ট্রাস্টি
অথচ ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানরা আজও সন্দেহভাজন, শুধুই পোশাক দেখে!
ইসলামের বিরুদ্ধে এই রাজাকার প্রচার: ইতিহাসের দ্বিতীয় অপরাধ

রাজাকাররা ইসলামের মুখোশ পরে অপরাধ করেছিল-এটা সত্য।
তারা জুমার খুতবা দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধকে “জিহাদ” বলেছিল-এটাও সত্য।
কিন্তু তারা কি ইসলাম প্রতিনিধিত্ব করেছিল? না। একেবারেই না।
কারণ:
ইসলাম কখনো দখলদার বাহিনীর পক্ষে গণহত্যাকে সমর্থন করে না
ইসলাম ধর্ষণ, বিশ্বাসঘাতকতা, লুটতরাজকে “ফরজ” বলে না
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন হাজারো আলেম, সুফি, মুসলমান যাঁদের মুখে ছিল দাড়ি, গায়ে ছিল পাঞ্জাবি

আমরা কি করবো?
প্রথমত – রাজাকারের পরিচয় ধর্মের মাধ্যমে নয়, অপরাধের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে
দ্বিতীয়ত – যাদের হাতে ৭১-এর রক্ত, তারা আজও সমাজে সক্রিয়-তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে
তৃতীয়ত – ইসলাম ও মুসলমানদের গায়ে ‘রাজাকার’ ট্যাগ লেপে দেওয়া ইতিহাসবিরোধী অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে
চতুর্থত – নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস শেখাতে হবে-যাতে তারা বিশ্বাসঘাতক আর ধর্মবিশ্বাসীর পার্থক্য বুঝতে শেখে
এই জাতি জানতে চায়-প্রকৃত রাজাকার কারা?

তাদের নাম, ঠিকানা, ছবি, অপরাধের রেকর্ড কোথায়?
তারা কিভাবে আবার প্রভাবশালী হলো?
ধর্মকে কেন ঢাল বানানো হলো?
আর ‘রাজাকার’ শব্দটা কি শুধুই মুসলমানদের গালি দেয়ার টুল হয়ে থাকবে?
আমরা বলি, আর না!

রাজাকার হলো এক ঘৃণিত রাজনৈতিক পরিচয়।
মুসলমান হওয়া রাজাকারের শর্ত নয়, দাড়ি বা পাঞ্জাবি রাজাকারের চিহ্ন নয়।
রাজাকার মানে বিশ্বাসঘাতক, যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী।
তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে-ধর্মকে কলঙ্কিত না করে, ইতিহাসকে সত্য করে।

ইতিহাস জানতে হলে সাহস চাই, মুখ খুলতে হলে বিবেক চাই। এই জাতি প্রস্তুত—-প্রকৃত রাজাকারের মুখোশ খুলে ফেলার জন্য, ধর্মকে কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার জন্য, নতুন প্রজন্মকে সত্য ইতিহাস জানানোর জন্য।কাল দ্বিতীয় পর্ব