“মানবিক শহর” না ‘জাতিগত নির্বাসন’?-গাজার মানুষের ভাগ্যে আর কত দুর্যোগ বাকি আছে!

নবজাগরণ প্রতিবেদন:৯ জুলাই ২০২৫
দূর দিগন্তে রাফাহ শহরের ধ্বংসস্তূপে জেগে উঠতে চলেছে এক ‘নতুন শহর’। কিন্তু এটি কোনো আশার শহর নয়। এটি এক নির্মম পরিকল্পনার প্রতিফলন-একটি ‘মানবিক শহর’ গড়ে তোলা হচ্ছে যেন গাজার ২১ লাখ মানুষের ঠাঁই হয় একটি বন্দী শিবিরে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন—সব ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তরের রূপরেখা তৈরি করতে।

অন্তত ছয় লাখ ফিলিস্তিনিকে ‘নিরাপত্তা যাচাই’-এর মাধ্যমে সেই শহরে ঢুকতে দেওয়া হবে-যেখানে ‘হামাস সংশ্লিষ্ট’ কেউ থাকলে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তারপর আর বের হওয়া যাবে না। মানবতা এখানে কোনো আশ্রয় পাবে না, বরং বন্দিত্বই হবে ভবিষ্যতের নাম।

এই ‘নতুন শহর’ কি আসলে একটি ‘কারাগার শহর’?
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে বাংলাদেশ, দেখেছে কীভাবে শরণার্থী হয়ে কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। গাজার মানুষ সেই অভিজ্ঞতারই আরেক প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের এই ‘মানবিক শহর’ পরিকল্পনা মনে করিয়ে দেয় ১৯৪৮ সালের নাকবা—যখন সাড়ে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের নিজভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ইসরায়েলের এই নতুন পরিকল্পনা কি সেই পুরাতন ‘জাতিগত নির্মূল’-এর কৌশলগত রূপ নয়?
বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবীরা একে বলছেন: “মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পরিকল্পিত অপারেশন”। গার্ডিয়ানে ইসরায়েলি মানবাধিকার আইনজীবী মাইকেল স্ফার্ড বলেন—“গাজার দক্ষিণে লোকজনকে জড়ো করে যাতে তাদের পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে উপত্যকা থেকে বিতাড়িত করা যায়—এই পরিকল্পনা তারই অংশ।”

আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্ট-জোরপূর্বক স্থানান্তর এক ধরনের যুদ্ধাপরাধ

জাতিসংঘ বহুবার বলেছে-“অধিকৃত ভূখণ্ডের বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক স্থানান্তর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং জাতিগত নির্মূলের সমতুল্য।” অথচ সেই আইনের লঙ্ঘনকে আজ ‘মানবিক শহর’ নাম দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এই বাস্তবতা যেন সেই ভয়াবহ চিত্র-যেখানে হত্যাযজ্ঞের পরিণতি হয় শরণার্থী জীবন। খাদ্য, ওষুধ, পানি ও বিদ্যুৎবিহীন রাফাহ আজ এক মৃত্যুর উপত্যকা—তার উপরই ‘নতুন শহর’ নির্মাণের পরিকল্পনা যেন ঘুমন্ত বিবেকের কফিনে শেষ পেরেক।

মানবিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ, ইতিহাস কি আবার রক্তমাখা পৃষ্ঠা লেখবে?

১৯৮২ সালে সাবরা ও শাতিলা ক্যাম্পে হাজারো ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল। আজকের পরিকল্পনা যেন তারই প্রতিধ্বনি—নতুন শতাব্দীতে নতুন কৌশলে জাতিগোষ্ঠী নির্মূলের মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। বার্লিন প্রাচীরের মতো এখানেও ‘মানবিক’ নামে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে মানুষদের ভবিষ্যৎ।

কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—চোখ বন্ধ করে থাকা বিশ্বের বিবেককে একদিন জেগে উঠতেই হয়। আজ যদি বিশ্ব চুপ থাকে, তাহলে আগামীকাল মানবতার অপমান সবার গায়ে লেগে থাকবে।

একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে: গাজার শিশুদের কান্না কি আমাদের বিবেক নাড়ায় না?

যখন রাফাহর মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে শত শত শিশুর দেহ, তখন নতুন শহরের নাম দিয়ে সেখানে নিরাপত্তা বলয়ের নামে নতুন প্রজন্মকে বন্দী করে রাখার প্রচেষ্টা মানবতার চরম লঙ্ঘন। এই শহর আসলে একটি ‘খোলা কারাগার’—যার দেয়াল নেই, কিন্তু মুক্তিও নেই।

আমরা প্রশ্ন করি-এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিশ্ব কবে মুখ খুলবে?
গাজা কোনো একাকী ভূমি নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত বিবেকের পরীক্ষাকেন্দ্র।
এই পরিকল্পনা বন্ধ হোক-না হলে ইতিহাসের বিচার এড়ানো যাবে না।
আপনার বিবেক যদি আজ চুপ থাকে, কাল আপনার কান্নাও কেউ শুনবে না।