খাল হত্যা মানেই জনপদের আত্মহত্যা: নোয়াখালীর জলাবদ্ধতা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতার নাম

নবজাগরণ ডেস্ক: সেনবাগ, নোয়াখালী ব্যুরো।
নোয়াখালীর মাটি তার মানুষকে জন্ম দিয়েছে নদী ও খালের কোলঘেঁষে। সেই ঐতিহাসিক পানি প্রবাহ-নির্ভর জনপদ আজ মরণব্যাধি জলাবদ্ধতায় হাঁসফাঁস করছে, কারণ তার শ্বাসনালী-খাল, বিল, নদী-আজ কেটে ফেলা হয়েছে। খাল মানেই জীবনের ধারা, খাল মানেই কৃষি-অর্থনীতি, খাল মানেই আমাদের পূর্বপুরুষদের পরিবেশজ্ঞান ও টিকে থাকার কৌশল। সেই খাল আজ কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে?

অবৈধ বাঁধ, ভেসাল জাল, অপরিকল্পিত প্রজেক্ট: খালের কবর রচনা!?
সেনবাগ উপজেলার ৩নং ডমুরুয়া ইউনিয়নের মইশাই ঈদগাহ বাজারের পাশ দিয়ে একসময় প্রবাহিত হতো প্রাণবন্ত একটি খাল, যা সারওয়াতলী ব্রীজ বড়খাল পর্যন্ত পানি সরবরাহ করত। আজ সেটি দখল হয়ে মৃতপ্রায়। এর পাশেই ছিল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাল-বখশগঞ্জ হাজার থেকে মইশাই নারায়নভাতুয়া হয়ে পরিকোট পর্যন্ত। সেটি ছিল বর্ষার পানি দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার মূল পথ। আজ তার চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না ;সেনবাগ-নাঙ্গলকোট সিমান্তে অবস্থিত।

এই খালগুলোকে হত্যা করেছে স্থানীয় দখলবাজি, প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঁধ, ভেসাল জাল, ময়লা-আবর্জনার পাহাড় এবং পলিথিনে নাকবুজে ফেলা দখলদারদের নির্লজ্জতা। খালের বুকেই আজ গড়ে উঠছে দোকান, ঘরবাড়ি, প্রজেক্ট-যেন প্রশাসনের চোখে ধুলা নয়, চোখেই কেউ নেই!

বন্যা এখন আর প্রাকৃতিক নয়-এটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ:
অধিক বৃষ্টিপাত কখনোই আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই বৃষ্টি আজ কেন ভয়াবহ বন্যার রূপ নিচ্ছে? কারণ জল নিষ্কাশনের সমস্ত স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাঁধ, জাল, অবৈধ স্থাপনা, এমনকি পরিকল্পনাহীন কালভার্ট নির্মাণও পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে। একে এখন আর প্রকৃতির অভিশাপ নয়-বরং আমাদের নৈতিক দেউলিয়াত্বের ফলাফল বলতে হবে।

জলাবদ্ধতা মানে: কৃষি ধ্বংস, রাস্তাঘাট অচল, রোগব্যাধির বিস্তার-
জলাবদ্ধতা শুধু ঘরের সামনে পানি জমা নয়-এটি গোটা অর্থনীতির শ্বাসরোধ করে। কৃষক তার ধান লাগাতে পারছে না, মৎস্যজীবী তার পুকুরে বিষক্রিয়ায় মাছ মরে যাচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষ অফিসে পৌঁছাতে পারছে না, স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা বইয়ের বদলে পানি বইয়ে দৌড়াচ্ছে। ডেঙ্গু ও পানিবাহিত রোগ ছড়াচ্ছে মড়কের মতো। এটাই কি সভ্যতা?

এখনই প্রয়োজন বিপ্লবী জন-উদ্যোগ:
আমরা যদি এখনই না জাগি, তাহলে এই খাল দখলদাররা আগামীতে আমাদের বসতবাড়িও গিলে খাবে। তাই সময় এসেছে প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক এবং জন-আন্দোলনের সমন্বয়ে একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ নেওয়ার।

১️. অবিলম্বে খাল দখলমুক্ত করতে হবে। ইউনিয়নের দফাদার, গ্রাম পুলিশদের মাধ্যমে সকল এলাকা থেকে খালের অবৈধ প্রতিবন্ধকতা অপসারণ শুরু হয়েছে, এটি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে।

২. জলাবদ্ধতার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। উপজেলা প্রশাসনের ঘোষণাকে শক্তিশালী করতে হবে জনচাপ ও গণমত দিয়ে।

৩. খালের পুনঃখনন ও সংস্কার জরুরি। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (LGED) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাধ্য করতে হবে পুরনো খালগুলোর ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করে পুনঃখননের জন্য প্রকল্প হাতে নিতে।

৪. হাটবাজারের ময়লা-আবর্জনার নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে ময়লা ব্যবস্থাপনার জন্য জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালু করা প্রয়োজন।

এই লড়াই রাজনীতি বা প্রশাসনের একার নয়-এটি জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ!
খাল বাঁচান মানেই শিশু বাঁচান, কৃষক বাঁচান, জীবন বাঁচান। এখন আর সময় নেই রাজনৈতিক দল বা প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকার। এখন সময়-প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে দাঁড়ানোর। খাল পরিষ্কার করুন, প্রতিবন্ধকতা অপসারণে সহায়তা করুন, দখলদারদের নাম সামাজিকভাবে প্রকাশ করুন।

স্মরণীয় রাখুন-খালকে হত্যা করা মানেই নিজের ভবিষ্যত ও পরিবেশকে হত্যা করা।
নবজাগরণে একটি আলোকবর্তিকা জ্বলুক-খাল উদ্ধারের মহাসংগ্রামে চলুন সকলে এগিয়ে আসি।

“একটা খাল উদ্ধার, একটা প্রাণ রক্ষা!
দখলমুক্ত খাল চাই-জীবন বাঁচাতে আন্দোলন চাই!”

বিস্তারিত জানতে পড়ুন শেয়ার করুন:
www.thenabajagaran.com