সংবিধান বৈধ না বিপ্লব?-বাংলাদেশের ‘জুলাই ঘোষণা’ ও ক্ষমতার আসল প্রশ্ন

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
“সংবিধান কোনো সাহিত্য নয়”-বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধান যদি কেবল আইনি দলিল হয়, তবে কি তা চিরকাল এক রকম থাকবে? কিংবা, জনগণের বিপ্লবী জাগরণে যদি শাসনব্যবস্থা পাল্টে যায়-তবে সেই সংবিধান কি তখনও বৈধ থাকে?

এ প্রশ্ন বাংলাদেশের জন্য এখন আর তাত্ত্বিক নয়-এটা সময়ের দাবি, ইতিহাসের অনিবার্য প্রশ্ন।
১. সংবিধান কি অবিনশ্বর?
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন-“স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও সংবিধানে নেই, তাই জুলাই ঘোষণাও থাকতে পারে না”। এটি এক ধরণের কূটনীতি, কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে।

আমরা ভুলে যাই, বর্তমান সংবিধান লেখা হয়েছে এক দলীয় বাস্তবতা ও সামরিক পটভূমিতে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে-সামরিক শাসকের হাতে, স্বৈরাচার ও দলীয় স্বার্থে। আজকের সংবিধান আর সেই ১৯৭২-এর আদর্শিক দলিল নয়-এটা এখন একটি বিতর্কিত, বিতর্কপূর্ণ, দ্বিমুখী দলীয় ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ দলিল।

সুতরাং, এ সংবিধানকে অবিনশ্বর মনে করাটাই আসলে ইতিহাসের সাথে প্রতারণা।

২. বিপ্লব কি অবৈধ?
সংবিধান যদি স্বতঃসিদ্ধ হয়, তাহলে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ অবৈধ ছিল। কেননা, সেসময়কার ‘আইনি সংবিধান’ ছিল পাকিস্তানের ১৯৫৬/১৯৬২ সংবিধান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানি সংবিধানের বাইরে গিয়ে জনতার স্বাধিকারের প্রশ্নে আন্দোলন করেছেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ-একটি বিপ্লব ছিল, বিদ্রোহ ছিল, এবং তা-ই আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে-যদি ১৯৭১ বৈধ হয়, তাহলে ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেন অবৈধ?

৩. সংবিধান বনাম জনতার শক্তি
বিপ্লব সফল হলে সংবিধান পাল্টায়-এটাই ইতিহাসের অভিজ্ঞান। রুশ বিপ্লবের পর জার শাসনের সংবিধান, পতাকা, সংগীত সব পাল্টে গেল। ইরানের ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে পতন হলো রাজতন্ত্রের, এবং নতুন সংবিধান রচিত হলো “ইসলামি বিপ্লবের চেতনায়”। তখন কেউ বলেনি-“আগের সংবিধানে নতুন চেতনা বসাতে পারি না”।

বাংলাদেশের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তাই কেবল একটি কাগজ নয়-এটা হলো একটি নতুন জনমত, নতুন রাষ্ট্রচিন্তা এবং জনগণের চেতনার দলিল। এ ঘোষণা হলো-‘রাষ্ট্রের মালিক জনগণ’ এর আধুনিক রূপায়ন।

৪. কাদের জন্য সংবিধান?
সংবিধান যদি জনগণের জন্য হয়, তাহলে জনগণের তৈরি আন্দোলন ও ঘোষণাকে তাতে অন্তর্ভুক্ত না করার যুক্তি চলে না। বিপ্লব সফল হলে সেটাই হয় নতুন আইন, নতুন বিধি, নতুন রূপরেখা।

তাহলে প্রশ্ন হলো-
জুলাই বিপ্লব যদি বৈধ না হয়, তাহলে শেখ হাসিনার পতনের দাবি কীভাবে যুক্তিযুক্ত? আর যদি জনতার গণঅভ্যুত্থান বৈধ হয়, তাহলে কেন সেই ঘোষণাপত্র সংবিধানে যোগ হবে না?

এই দ্বৈতনীতি আসলে রাজনৈতিক হীনতা। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সংবিধানকে অস্ত্র বানানো।
৫. চতুর্থ তফসিলে ‘চেতনা’ নয়, ঘোষণা চাই

বিএনপি প্রস্তাব করছে-চতুর্থ তফসিলে ‘চেতনা’ রাখা হোক। কিন্তু ‘চেতনা’ কি আইনি দলিল? ‘জুলাই ঘোষণা’ একটি স্পষ্ট রূপরেখা-যেখানে আছে সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচারবিভাগ ও আমলাতন্ত্র পুনর্নির্মাণের রূপরেখা।

এই ঘোষণা চেতনা নয়-নতুন রাষ্ট্র গঠনের নকশা।
সংবিধান জনগণের অধীন, জনগণ সংবিধানের নয়?

বাংলাদেশ এখন একটি ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যেমন পুরোনো উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল, তেমনি ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব নতুন ‘অন্তঃসারশূন্য গণতন্ত্র’ ও ‘ভোটাধিকারহীন শাসনের’ বিরুদ্ধে। যে বিপ্লব রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে চায়-তাকে সংবিধানের বাইরে ভাবা যাবে না।

জুলাই ঘোষণাপত্র সংবিধানের ভিত্তি না হলে-এ বিপ্লবও অসম্পূর্ণ, আর সংবিধানও অবৈধ।
সংবিধান রক্তে লেখা হলে, ইতিহাস বিপ্লবের রক্তে লেখা হয়। এবং ইতিহাস সবসময় জনগণের পক্ষেই থাকে-কোনো কাগজপত্রের নয়।

www.thenabajagaran.com
#জুলাইবিপ্লব #সংবিধানপুনর্লিখন #নবগণতন্ত্র #নবজাগরণ