মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রাজু ভাস্কর্যের প্রান্তে আজ ফের জেগে উঠলো বৃহত্তর নোয়াখালীর সন্তানেরা। বিক্ষোভ আর মানববন্ধনে তারা কেবল বক্তব্য দেয়নি-তারা ইতিহাসের এক গভীর ব্যথা, রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অবহেলা আর জলবদ্ধ ভবিষ্যতের বিপন্নতা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে জাতির বিবেকের।
নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষীপুর-এই তিনটি জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের এক বিশাল সম্ভাবনার জনপদ, আবার একইসঙ্গে রাজনৈতিক কেন্দ্রচ্যুতির নির্মম শিকার। এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল, কৃষি জমি, লোকসংখ্যা-সবই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় ‘বঞ্চনার তালিকায়’ স্থান পায় বারবার। আর তাই আজকের এই বিক্ষোভ ছিল নিছকই কোনো ছাত্রসংগঠনের আয়োজিত কর্মসূচি নয়-এ ছিল অবরুদ্ধ জনপদের, ডুবন্ত ভবিষ্যতের, তলিয়ে যাওয়া সম্ভাবনার আর্তনাদ।
মানববন্ধনে বক্তৃতা করেছেন নোয়াখালী ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মাহফুজ রহমান; জাতীয় যুবশক্তি ও এনসিপির কেন্দ্রীয় সংগঠক মোঃ কামরুজ্জামান, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের মূখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মোদাচ্ছের চৌধুরীসহ অসংখ্য তরুণ নেতৃত্ব। তাদের কণ্ঠে ছিল স্পষ্ট দাবি:
“খাল খনন করো, নদী উদ্ধার করো, বাঁধ নির্মাণ করো-নয়তো বৃহত্তর নোয়াখালীকে ডুবিয়ে মারার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে!”
অবহেলিত জনপদের ইতিহাস:
নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষীপুরে গত দশকে একের পর এক বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা আর নদীভাঙন মানুষকে বারবার ঘরছাড়া করেছে। খাল দখল, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর দুর্নীতিপরায়ণ স্থানীয় শাসনব্যবস্থার কারণে এলাকার প্রধান পানি নিষ্কাশন পথগুলো প্রায় মৃত। বৃষ্টির দিনে বিদ্যালয় মাঠ নদী হয়ে যায়, কৃষিজমি হয়ে পড়ে অচাষযোগ্য, শত শত গ্রাম হয় জলমগ্ন।
প্রশ্ন হলো-কোথায় ছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়? কোথায় স্থানীয় প্রশাসন? কোথায় পানি উন্নয়ন বোর্ড?
রাষ্ট্র কেন এই দাবি শুনছে না?
রাষ্ট্রের কেন্দ্র যদি ঢাকায় হয়, তাহলে রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়িয়ে বৃহত্তর নোয়াখালীর সন্তানরা আজ সেই কেন্দ্রবিন্দুকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ঢাকার বুকে তাদের এই গর্জন-“পানি চাই, ন্যায্যতা চাই, বাঁচার অধিকার চাই”-প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাষ্ট্রের পাথরপ্রাচীরেও। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-রাষ্ট্র কি সত্যিই শুনছে?
এটা কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নয়। এটা কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’ বনাম ‘আঞ্চলিক অধিকার’-এর লড়াই। এখানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে উপকূলীয় জেলার জন্য বরাদ্দ না থাকাটাও রাজনৈতিক অবিচার। এখানে খাল উদ্ধার না হওয়াটাও রাজনৈতিক পক্ষপাত। এবং এই অবিচারের বিরুদ্ধে আজকের এই ছাত্রগণজোট এক সাহসী পদক্ষেপ।
দাবিগুলো কী?
মানববন্ধনে বক্তারা যে দাবিগুলো তুলে ধরেছেন, তা অবিলম্বে বাস্তবায়নের মতো জরুরি ও যৌক্তিক:
১. বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান খাল ও নদীগুলো অবিলম্বে খনন করতে হবে।
২. আধুনিক টেকসই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে প্রতিটি উপজেলায়।
৩. প্রয়োজনীয় বাঁধ ও পাম্প স্টেশন নির্মাণ করে এলাকার বন্যা ও জলাবদ্ধতা রোধ করতে হবে।
৪. দখলদারদের হাত থেকে খাল ও নদী উদ্ধার করতে হবে।
৫. জলবায়ু-সহনশীল উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৃহত্তর নোয়াখালীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এই আন্দোলন থেমে থাকবে না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে এই যে তরুণরা জড়ো হলো-তারা কেবল খাল খননের জন্য নয়, তারা নিজেদের অস্তিত্বের দাবিতে, এক ন্যায্য রাষ্ট্রকাঠামোর প্রশ্নে, পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতের জন্য মাঠে নেমেছে। তাদের চোখে-মুখে ছিল ক্ষোভ, কণ্ঠে ছিল আগুন, আর অন্তরে ছিল বাঁচার আকুতি।
আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি-এই আন্দোলন কেবল শুরু। যতদিন না বৃহত্তর নোয়াখালীর জলবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়, যতদিন না রাষ্ট্রের উন্নয়ন বৈষম্য দূর হয়, ততদিন তারা থামবে না। তারা আবারো আসবে, আবারো কাঁপাবে, এবং শেষ পর্যন্ত এই রাষ্ট্রকে বাধ্য করবে জলবদ্ধতা নয়, ন্যায্যতা দিতে।
লেখক:সম্পাদক- নবজাগরণ।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন শেয়ার করুন :
www.thenabajagaran.com