নবজাগরণ ডেস্ক:
মঞ্চের উপর বসে আছেন যাঁরা সন্তান হারিয়েছেন-শহীদদের মা-বাবা,চোখে-মুখে শোক নয়, দৃঢ়তা;বুকভরা বেদনা নয়,শ্রদ্ধার শক্তি। আর ঠিক সেই মঞ্চের নিচে, সাদামাটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। এই দৃশ্য শুধুই এক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের চিহ্ন নয়-এ এক রাজনৈতিক ভূমিকম্প। ক্ষমতার কাঠামো উল্টো হয়ে গেছে। এবং এই উল্টে যাওয়া ইতিহাসের নাম জুলাই বিপ্লব।
এই দৃশ্য যদি হতো ২০২৪ সালে, হয়তো কেউ তা বিশ্বাসই করত না। কে কাকে সম্মান দেবে, কার মুখে শোক থাকবে, আর কার কণ্ঠে অনুশোচনা-তা পূর্বনির্ধারিত ছিল। কিন্তু ২০২৫-এর এই জুলাই আমাদের শিখিয়েছে,ইতিহাসে যখন গণমানুষের হাতে নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে,তখন প্রতীকগুলোর অবস্থানও বদলে যায়। সম্মান আর ক্ষমতার ভারসাম্য নতুনভাবে রচিত হয়।
আজ নারায়ণগঞ্জে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ’ উদ্বোধনের সময় এই উল্টো ভারসাম্যকে আমরা দেখলাম বাস্তবে।
সাদা পাঞ্জাবিতে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান, তার পাশে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আলোচিত পরিবেশ অধিকারকর্মী ও এখনকার উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার-তাঁরা কেউ নন চিরাচরিত রাজনৈতিক ক্ষমতার ধারক। তাঁরা এসেছেন শহীদের শ্রদ্ধা জানাতে,আহতদের হাতে গলা ধরা কণ্ঠে ক্ষমা চাইতে।আর এখানেই জুলাই বিপ্লব আলাদা-এটা ক্ষমতা নয়, এটা দায়বদ্ধতার নাম।
রাষ্ট্র পুনর্গঠনের বেদীমূলে শহীদ রক্ত?
জুলাই অভ্যুত্থানে যারা প্রাণ দিয়েছে, তারা ক্ষমতার জন্য নয়,তারা একটা নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য লড়েছে। যেটা আর কোনো দলের হাতের পুতুল নয়, যেটা আর কোনো ক্যান্টনমেন্ট-কেন্দ্রিক অভিজাত সমাজের নিরাপত্তা দেয়াল নয়।
এই আন্দোলন ছিল-সংবিধানকে জনতার দিকে ফেরানো, রাষ্ট্রের কেন্দ্রকে ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, এবং নাগরিকের কাছে রাষ্ট্রকে জবাবদিহিমূলক করার জন্য।
মা-বাবার চোখে নতুন বিচারব্যবস্থা
আজ শহীদদের বাবা-মা’র চোখে চোখ রাখে যখন উপদেষ্টারা, তারা কোনো আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেন না। তারা বলেন-“আমরা আসছি তোমাদের কাছে, ক্ষমা চাইতে, দায় নিতে,ভবিষ্যত গড়তে।”এই বক্তব্য বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী বার্তা। শহীদের মা-বাবা এখন শুধু কাঁদেন না, তারা রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক মালিক। এই অবস্থান,এই মনোভঙ্গি-বিপ্লব ছাড়া আসে না।
আমাদের শিক্ষা:শহীদদের রক্ত বৃথা যায় না
যেসব তরুণ জুলাইয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, যাঁরা পঙ্গুত্ব নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, আজ তাঁরা দেখছে যে তাঁদের রক্ত দিয়ে রচিত হচ্ছে নতুন সংবিধানের ভিত্তি। এই সংবিধান হবে গণ-শক্তির, জনগণের মালিকানার, বিকেন্দ্রীকরণের। এই রাষ্ট্র হবে না ঢাকামুখী, এই রাষ্ট্র হবে মানুষমুখী।
ভবিষ্যতের ডাক
আজ যারা মনে করে এই অন্তর্বর্তী সরকারই যথেষ্ট,তারা বোঝে না-এটা তো কেবল শুরু। শহীদের সম্মান শুধু ফুল দিয়ে হয় না। শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হয় রাষ্ট্র কাঠামো বদলে, বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে, পুলিশ-প্রশাসনের ক্ষমতা হ্রাস করে জনগণকে কাণ্ডারির আসনে বসিয়ে।
এই পুরো দৃশ্যপট,মঞ্চ আর নিচের বৈপরীত্য-আমাদের শিখিয়েছে,গণমানুষের ইতিহাসে দিন আসে, যখন চেয়ারের অবস্থানই বলে দেয় কার হাতে সত্যিকারের ক্ষমতা।