মন্ত্রণালয়ের নামে দুর্বৃত্তায়ন: রাষ্ট্র চালাতে চেয়ে রাষ্ট্র খাচ্ছে!”

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
একটি রাষ্ট্র কত মন্ত্রণালয় প্রয়োজন-এই প্রশ্নটি নিছক প্রশাসনিক বা কাঠামোগত কোনো বিতর্ক নয়;এটি রাষ্ট্রের কার্যকারিতা,সেবার মান এবং করদাতার অর্থের ন্যায্য ব্যবহারের প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি চালায় মাত্র ১৫টি মন্ত্রণালয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশের মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ১৫-২০ এর মধ্যেই। ভারত,যা বাংলাদেশ থেকে ২২ গুণ বড়,সেখানেও মন্ত্রণালয় মাত্র ৫৪টি। অথচ ক্ষুদ্র আয়তন,দুর্বল অর্থনীতি ও সীমিত সম্পদের বাংলাদেশে আজ ৫৪টি পূর্ণ মন্ত্রণালয় ও শতাধিক অধিদপ্তর গিজগিজ করছে!

পদ পদবি বিলানোর খেলায় রাষ্ট্রযন্ত্র জিম্মি
বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে কোনো কৌশলগত পরিকল্পনার কারণে নয়-বরং এটি রাজনৈতিক লুটপাট,পদ বিতরণ ও আমলাতন্ত্রের সম্প্রসারণের ফল। প্রতিটি নতুন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জুড়ে যায় হাজারো কর্মকর্তা, সচিব,উপসচিব,অতিরিক্ত সচিব-যারা সকলেই গাড়ি, ড্রাইভার,জ্বালানি,নিরাপত্তা ও সরকারি বাসভবনের সুবিধা পান করদাতাদের অর্থে।

এ যেন এক ব্যয়বহুল রাষ্ট্রীয় চাকচিক্যের সার্কাস,যেখানে সেবা নয়,খরচই একমাত্র বাস্তবতা। জনগণ কি পায়? দুর্নীতি, ঘুষ,হয়রানি আর অকার্যকরতা। রেল মন্ত্রণালয় ব্যর্থ,বিমান মন্ত্রণালয় অকার্যকর,শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংকটে, সড়ক যোগাযোগ ব্যয়বহুল অথচ ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ই যেন “ঘর পোড়া গরুর পেছনে পানি ঢালার”চিত্র।

বিসিএস: আশার মরীচিকা নাকি যুব সমাজের নিয়ন্ত্রক ফাঁদ?
গত দেড় দশকে বাংলাদেশে বিসিএস পরীক্ষাকে একটি অলৌকিক আশার উৎস হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে।বেকার যুবক-যুবতীদের হতাশা ঠেকাতে বিসিএস একপ্রকার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।বাস্তবে এই পরীক্ষা দীর্ঘসূত্রতা,গাইডবই নির্ভরতা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট পদ্ধতির জালে আবদ্ধ। পরীক্ষার নামে বছরের পর বছর মানুষকে ঝুলিয়ে রাখা হয়-এতে করে আন্দোলনের শক্তি ভোঁতা হয়,তরুণদের হতাশা নিয়ন্ত্রণে থাকে।

এ যেন এক রাষ্ট্রীয় স্ট্র্যাটেজিক ম্যানিপুলেশন-যেখানে সরকার জানে,বিসিএস পরীক্ষাই সবচেয়ে সস্তায় সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রণমূলক হাইপ। অথচ আপনি যদি হার্ভার্ড বা এমআইটি থেকে পাশ করা কোনো ছাত্রকে বলেন বিসিএস দিতে-তারা চটি বই না পড়ে পাশ করবে না। কেন? কারণ এই পরীক্ষাটি বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা নয়, মুখস্থবিদ্যার প্রমোশন।

ব্রেইন ড্রেইনের বদলে ব্রেইন গেইন চাই?
বাংলাদেশের যেসব মেধাবী ছেলে-মেয়েরা বিদেশে পড়ালেখা করছে,তাদেরকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আনার কোনো কার্যকর পদ্ধতি নেই। ওরা সরকারি চাকরিতে আগ্রহী নয়,কারণ এ দেশে মেধা নয়,পেশাগত আনুগত্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক মানের নিয়োগ পদ্ধতি ও স্কাউটিং সেল গঠন করতে হবে-যা বিদেশে বা দেশে থাকা গুণমানসম্পন্ন মানুষদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের সেবায় যুক্ত করতে পারে।

এত আমলা, এত মন্ত্রী কিন্তু সেবা কোথায়?
বাংলাদেশে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব মিলিয়ে বর্তমানে কয়েক হাজার জন ব্যক্তি রাজস্বভিত্তিক ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ শিক্ষা,স্বাস্থ্য,গবেষণা,প্রযুক্তি ও ন্যায্য সমাজব্যবস্থায় বরাদ্দ নেই। আমলারা দিনের পর দিন অফিসে না গিয়েও বিল নিচ্ছে,মন্ত্রীরা বিদেশ ভ্রমণে ব্যস্ত, অথচ নীতি-কৌশলহীন রাষ্ট্রে মানুষ আজ অসহায়।

একদিকে সরকার গরিব,অন্যদিকে ব্যয়বহুল একটি প্রশাসন বয়ে বেড়াচ্ছে।এমনকি কিছু দপ্তরের কাজ কেবল চায়ের কাপ ঘোরানো-উৎপাদনশীলতা শূন্য। এসব “অলস মন্ত্রণালয়” বিলুপ্ত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা চাই, পর্যালোচনা দরকার
সচেতন নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন-বাংলাদেশে এখনই একটি আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করতে হবে। ব্যয়সংকোচন নীতিমালার আওতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সত্যিকারের সংস্কার চায়-তবে প্রথম কাজ হবে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা।

কম মন্ত্রণালয়,বেশি দক্ষতা:
রাষ্ট্র চালাতে দক্ষতা লাগে,লোক দেখানো মন্ত্রণালয় নয়। মন্ত্রণালয় কমিয়ে একটি দক্ষ,আধুনিক,তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক ও জনমুখী প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। আর এর জন্য লাগবে সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক সংস্কার। নয়তো জনগণ কেবল কর দিবে, আমলারা কেবল ভোগ করবে-এমন রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুর্ভিক্ষ অনিবার্য।
“দেশ চালাতে হলে রাষ্ট্রকে গড়তে হবে, রাষ্ট্র খেতে থাকলে দেশ মরবে।”
লেখক: সম্পাদক-নবজাগরণ।