গোপালগঞ্জে এপিসি বিতর্ক নয়, আলোচনায় আসা উচিত রাষ্ট্রীয় সহিংসতার দায়: চার ঘণ্টার নারকীয় আক্রমণে বেঁচে ফিরেছে যারা, তাদের অপমান নয়, সম্মান প্রাপ্য

গোপালগঞ্জে এপিসি বিতর্ক নয়, আলোচনায় আসা উচিত রাষ্ট্রীয় সহিংসতার দায়: চার ঘণ্টার নারকীয় আক্রমণে বেঁচে ফিরেছে যারা, তাদের অপমান নয়, সম্মান প্রাপ্য

নবজাগরণ রিপোর্ট :
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের উপর হামলার ভয়াবহতা এখন কেবল একটি রাজনৈতিক অনুরণন নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও একটি পক্ষপাতদুষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্ন বাস্তবচিত্র। অথচ এই রক্তাক্ত ঘটনার মূল প্রতিচ্ছবি ছাপিয়ে মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে একটি ‘এপিসি’ ভিডিও। নেতাদের বাঁচাতে সেনাবাহিনীর আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ারে (এপিসি) ওঠার ঘটনা এখন যেন ‘আলোচনার প্রধান থালা’। বিস্ময়কর হলেও সত্য!

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-এপিসিতে ওঠা নাকি নেতৃত্ব হত্যার পরিকল্পনার থেকে বড় খবর? রাষ্ট্র যখন নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, যখন কয়েক হাজার অস্ত্রধারী হামলা চালায় একটি বৈধ রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপর, তখন মূল ফোকাস হওয়া উচিত সন্ত্রাসীদের উৎস, হামলার নেপথ্য শক্তি ও রাষ্ট্রের নীরবতা।

গোপালগঞ্জে কি হয়েছিল?
১৬ জুলাই, গোপালগঞ্জ অভিমুখী এনসিপি’র মিছিল ও সমাবেশ লক্ষ্য করে চলে অব্যাহত হামলা, গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ। চার ঘণ্টা ধরে রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হয় এক পরিকল্পিত যুদ্ধ। প্রশাসন ছিল নিঃসাড়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অকার্যকর, আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথাকথিত রিপোর্ট ছিল- ‘অন্ধকারে হাতড়ানো পঙ্গু নথি’। ঠিক এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে রক্ষা পায় এনসিপি নেতারা।

সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত ও তুহিনের ব্যাখ্যা:
এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয়, ফেস বাই ফেস সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে হবে, প্রয়োজনে এপিসিতে। তুহিনের কথায়, শীর্ষ নেতারা প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু অবস্থা বেগতিক হলে তাদেরকে প্রায় জোর করেই তোলা হয়। এরপরও তারা নামতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সহযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে আবার তুলেন- এটি ছিল আত্মরক্ষার সংগ্রাম, কোনো আরামপ্রিয় পালানোর গল্প নয়।

কার উপর হামলা? কার জীবন ঝুঁকিতে?
এই প্রশ্নটি তোলার সময় এসেছে:
সন্ত্রাসীরা কার উপর হামলা চালায়?
কার গাড়ি লক্ষ্য করে ককটেল ও গুলি চালানো হয়?
কার গাড়ির কাচ ভেঙে পড়ে এবং রক্ত ঝরে?

নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও আখতার রহমানের নামে সুনির্দিষ্ট ‘হত্যা পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছিল। কাজেই এই নেতারা যদি এপিসিতে না উঠতেন, প্রাণে না বাঁচতেন, তাহলে আজ শিরোনাম হতো: “নেতৃত্বহীন এনসিপি, তিন নেতা শহীদ”। তারপর হয়তো কিছু কুমিরের অশ্রু ঝরতো মিডিয়ায়।

এপিসি বিতর্ক: বিকৃত চেতনার ফাঁদ?
আজ যারা এপিসি নিয়ে বিদ্রুপ করছে, তারা হয় বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, নয়তো কোনো প্রতিক্রিয়াশীল পরিকল্পনার অংশ। তুহিনের ভাষায়:

“আপনারা একটা সন্ত্রাসী বাহিনীকে ছাপিয়ে এপিসি নিয়ে পড়ে থাকবেন জানলে সবাই ওইখানেই মরে যেতাম।”
সত্যিই, এই ধরণের ট্রল ও কুৎসা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনকে আড়াল করে, শহীদদের অসম্মান করে এবং ভবিষ্যতের সংগ্রামীদের মনোবল ভেঙে দিতে চায়।

গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের ভূমিকা: চরম প্রশ্নবিদ্ধ
গোপালগঞ্জে কীভাবে কয়েক হাজার অস্ত্রধারী একত্র হলো? কারা তাদের সংগঠিত করলো? গোয়েন্দা রিপোর্ট কোথায় ছিল? প্রশাসনের প্রতিরোধ পরিকল্পনা কোথায় ছিল?

গোয়েন্দা ব্যর্থতা না রাষ্ট্রযন্ত্রের ইচ্ছাকৃত চরম পদস্খলন?
গোপালগঞ্জে যখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনসভা করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন- সেই ঘটনাগুলোর খবর রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নিশ্চয়ই রেকর্ডে ছিল। রাষ্ট্রের এমন স্পর্শকাতর অঞ্চলের সামাজিক মনস্তত্ত্ব, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বিদ্যমান প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গোয়েন্দা বিভাগগুলো ন্যূনতম বিশ্লেষণ করলেও তারা জানত- ঐ এলাকায় ভিন্নমতের উপস্থিতি মানেই ঝুঁকি।

তাহলে প্রশ্ন জাগে-কেন সেইসব গোয়েন্দা রেকর্ড, পুরনো নজির ও রাজনৈতিক ভূ-সংবেদনশীলতাকে আমলে না নিয়ে, জাতীয় নাগরিক পার্টির মতো একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে সেখানে পাঠানো হলো? কেন বিপ্লবীদের মুখোমুখি হতে হলো মৃত্যুর সম্ভাবনা, পেটোয়া বাহিনীর লাঠি, দমন-পীড়ন আর অবরুদ্ধ সমাবেশের? এটি নিছক গোয়েন্দা ব্যর্থতা নয়-এটি রাষ্ট্রযন্ত্রেরই এক চরম, পরিকল্পিত অপারগতা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চক্রান্ত।

গোপালগঞ্জের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে-বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা কেবলমাত্র ক্ষমতাসীনদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। যারা ক্ষমতার বাইরে, যারা বিদ্যমান বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়, তাদের জন্য এই রাষ্ট্র ও তার গোয়েন্দা বাহিনী যেন এক নিষ্ঠুর ফাঁদ!

এই ঘটনার পর আর একবিন্দুও সন্দেহ থাকার কথা নয়— আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা গোষ্ঠীর ‘প্রাইভেট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে’ পরিণত হয়েছে। যারা ভবিষ্যৎ বিপ্লবীদের রক্ষা করবে, পথনির্দেশনা দেবে, রাষ্ট্রের সত্যিকার দুর্বলতা চিহ্নিত করবে-তারাই এখন বিপ্লবী কাফেলাকে ফাঁদে ফেলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে!

এটা শুধু ব্যর্থতা নয়-এটা এক ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহ। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত গোয়েন্দা সংস্থা যদি জনগণের বিপক্ষেই ব্যবহৃত হয়, তবে সেই রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না-বরং শোষকের দালাল হিসেবে কাজ করে।

এখানেই সময় এসেছে একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার— যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই আগুন নেভাবে, এবং জনগণের পক্ষের রাজনীতি রক্ষা করবে। আমাদের দরকার জনগণের গোয়েন্দা সংস্থা, রাষ্ট্রের নয়; বিপ্লবের পক্ষে, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে।

তুহিন স্পষ্টই বলেন:
“প্রশাসনের ব্যাকআপ নিয়ে আর কিছু বললাম না। তারা মনে হয় শুরুতে চাইছিল হাসনাতরা মরে যাক।”
এটি যদি সত্য হয়, তবে এটি শুধুই রাজনৈতিক সহিংসতা নয়, এটি ‘রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তায় সংঘটিত পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা প্রচেষ্টা’।

জাতীয় নেতাদের রক্ষা নয়,গর্ব করা উচিত
নেতাদের রক্ষা করা একটি অপরাধ নয়-এটি একটি সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। যারা আজ এপিসি বিতর্কে নেতাদের নিন্দা করছেন, তারা ভবিষ্যতের শহীদের তালিকায় নাম লেখাতে প্রস্তুত থাকুন।

একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে নেতৃত্ব দিতে যারা জীবন দিয়ে লড়ছেন, তাদের প্রহসনের শিকার করা উচিত নয়।
বরং আমাদের বলা উচিত-“তোমরা ফিরে এসেছো বলেই আবার আমরা সামনে এগোতে পারছি।”

বিস্তারিত জানতে পড়ুন:
www.thenabajagaran.com