নবজাগরণ আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিশ্ব ইতিহাসে প্রতিরোধ, প্রযুক্তি ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার এমন নাটকীয় সমন্বয় খুব কমই দেখা যায়, যেমনটি ঘটেছে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচিকে ঘিরে। এই ইতিহাসের কেন্দ্রে ছিলেন একমাত্র বিজ্ঞানী, যার নাম শুনলে পশ্চিমা বিশ্বের গোয়েন্দারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত-ড.আবদুল কাদির খান।
মোসাদ-র এর ছায়াযুদ্ধ
১৯৭৪ সালে ভারত যখন প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা চালায়,তখনই পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝে নেয়, অস্তিত্ব রক্ষায় এই অস্ত্র অপরিহার্য। জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন:
“আমরা ঘাস খাব, ক্ষুধার্ত থাকব,কিন্তু নিজের বোমা তৈরি করব।”
এই ঘোষণার বাস্তবায়ন শুরু হয় ইউরোপ থেকে সেন্ট্রিফিউজ নকশা নিয়ে দেশে ফেরা সেই তরুণ বিজ্ঞানীর হাত ধরে। আবদুল কাদির খান হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের ‘নিউক্লিয়ার ফাদার’-তবে এই যাত্রা ছিল মৃত্যুঝুঁকি ও বহির্বিশ্বের ষড়যন্ত্রে পরিপূর্ণ।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ১৯৮০ দশকে পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি, ধ্বংসাত্মক চিঠি বোমা ও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে হামলা চালানোর পরিকল্পনা নেয়। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মিলে কাহুটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে যৌথ বিমান হামলা চালাতে চায়। ইসরায়েলের এফ-১৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ভারতের জামনগর বিমানঘাঁটি থেকে উড়ে গিয়ে এই হামলা চালাবে-এই ছিল চূড়ান্ত পরিকল্পনা।
প্রথমদিকে ইন্দিরা গান্ধী সায় দিলেও পরে কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা উদ্বেগের কারণে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এই কারণে মোসাদ-ভারত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, তবে ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি।
কাদির খানকে হত্যার বারবার চেষ্টা
বিশ্বের বহু আন্তর্জাতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে, কাদির খানকে হত্যার জন্য চিঠিবোমা, রাসায়নিক হামলার পরিকল্পনা, এমনকি তাকে গুম করার কৌশল নিয়েছিল মোসাদ। ইউরোপে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোতেও চালানো হয় নাশকতা। অথচ সেই সময় পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। কারণ, তখন আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ঠেকাতে আমেরিকা পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করছিল।
ওয়াশিংটনের চোখের সামনে পাকিস্তান পারমাণবিক কর্মসূচি চালালেও, চুপচাপ ‘অন্ধ’ হয়ে থাকল যুক্তরাষ্ট্র। আরও বিস্ময়করভাবে চীন পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, ট্রিটিয়াম এবং অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের সহায়তা দেয়, যা কর্মসূচিকে নতুন গতি দেয়।
১৯৯৮: জবাবি বিস্ফোরণ
১৯৯৮ সালের ১১ মে ভারত দ্বিতীয় দফা পারমাণবিক বিস্ফোরণ চালালে, পাকিস্তান মাত্র ১৭ দিনের ব্যবধানে ২৮ মে চগাই পাহাড়ে সফলভাবে পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। এই বিস্ফোরণ শুধু বোমার ছিল না, ছিল সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরোধের বিস্ফোরণ।
এই পরীক্ষার পর আবদুল কাদির খান হয়ে ওঠেন ‘মিলেটারি আইকন’, জাতীয় বীর, এবং ইসলামী বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক রাষ্ট্র নির্মাতার প্রতীক।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি বনাম জাতীয় স্বার্থ
এখানে প্রশ্ন উঠে:কেন ইসরায়েল এতটা মরিয়া ছিল পাকিস্তানকে পারমাণবিক শক্তিধর হতে না দেওয়ার জন্য?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে। ইসরায়েল চাইত, মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশ যেন পারমাণবিক শক্তিধর না হয়। ভারতের সঙ্গে তাদের সামরিক ও গোয়েন্দা সম্পর্ক সেই কৌশল বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে-যে জাতি স্বপ্ন দেখে, ত্যাগ করে এবং নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় দৃঢ় থাকে, তাকে কেউ থামাতে পারে না।
কাদির খানের শিক্ষা:প্রতিরোধই চূড়ান্ত অস্ত্র
আবদুল কাদির খান শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না,ছিলেন এক প্রকার প্রতিরোধের দার্শনিক। শত ষড়যন্ত্র, জীবনহানির আশঙ্কা, আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন,
“স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই,আত্মরক্ষার কোনো শর্টকাট নেই।”
আজও তিনি স্মরণীয়-সাহসী দেশপ্রেমিক, যার বীরত্বের গল্প কেবল পাকিস্তানের নয়,বরং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিটি সংগ্রামী জাতির।
যতই ইসরায়েল, ভারত বা মোসাদ মিলে হামলা ছক কষুক, কাদির খানের মতো মানুষদের দমন করা যায় না। ইতিহাসে তাঁরা থেকেই যান, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শেখান—“ঘাস খেয়েও যদি প্রয়োজন হয়, দেশের জন্য বোমা তৈরি করতেই হবে!”
আপনার মতামত দিন, শেয়ার করুন, ছড়িয়ে দিন-সত্য ইতিহাসের বিপ্লবী গাঁথা যেন চাপা না পড়ে কূটনীতির ধূর্ত পর্দার আড়ালে।