ভুলে যাওয়া শহীদের প্রশ্ন: “আমার বাবার কথা কেউ বলে না কেন?”

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী :
জুলাই গণঅভ্যুত্থান-২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিশাল প্রতিরোধের নাম, এক প্রজন্মের আত্মদানের প্রতীক। অথচ এক বছরের মাথায়ই কিছু শহীদের নাম উচ্চারিত হয় বারবার, আর অনেকের নাম চলে গেছে বিস্মৃতির গহ্বরে। বিশেষত শ্রমজীবী শহীদদের নাম, যারা ছাত্র না হয়েও ছিলেন এই গণঅভ্যুত্থানের নায়ক।

১৯ জুলাই ২০২৪, যাত্রাবাড়ী।
“ছাত্র অধিকার পরিষদ”-এর সংগঠক, কবি নজরুল সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্র জিহাদ হোসেন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ঠিক এক বছর পর আজ, ১৯ জুলাই ২০২৫, কাজলা ব্রিজের নিচে বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদের আয়োজনে তার স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে বক্তব্য রাখেন যুব অধিকার পরিষদ নেতা মুজাহিদুল ইসলাম।

কিন্তু এই দিনেই আমরা ভুলে যাই এক শহীদের কথা-যিনি ছাত্র ছিলেন না, ছিলেন শ্রমিক।
চট্টগ্রামের ষোলশহরের একটি ফার্নিচারের দোকানে কর্মরত ফারুক নামের সেই মানুষটির কথা।

শ্রমিক শহীদ ফারুক:নিঃশব্দ নায়ক
১৬ জুলাই ২০২৪, দুপুর।
‘বিসমিল্লাহ হোটেল’-এ তড়িঘড়ি করে দুপুরের খাবার সেরে বাইরে বের হচ্ছিলেন ফারুক। ঠিক সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। রক্তাক্ত দেহটা তখনও হাতমুছা শেষ করতে পারেনি।
তাঁর গায়ে কোনো দামী পোশাক ছিল না-ছিল কেবল একজন পরিশ্রমী শ্রমিকের কর্মজীবনের প্রতিচ্ছবি।

তিনি কোনো মিছিলের নেতা ছিলেন না, কোনো সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন না। ছিলেন শুধুই একজন সৎ পরিশ্রমী মানুষ, যিনি গণঅভ্যুত্থানের সময় সাহস করে বেরিয়েছিলেন গণমানুষের কণ্ঠ হয়ে দাঁড়াতে।

শহীদের মেয়ের হৃদয়বিদারক প্রশ্ন?
মাত্র ৮ বছরের ছোট্ট ফারিহা-ফারুকের মেয়ে-জানতে চায়:
“আম্মু, সবাই আবু সাইদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ’র কথা বলে, কিন্তু আমার বাবার কথা কেউ বলে না কেন?”

এই প্রশ্ন শুধু এক শিশুর নয়-এ প্রশ্ন গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।
একজন মানুষ যদি ছাত্র না হয়, শ্রমিক হয়, তাহলে কি তার রক্তের মূল্য কমে যায়? শহীদ ফারুকের রক্ত কি গণঅভ্যুত্থানের গাথায় লেখা হয় না?
তার স্ত্রী সীমা আক্তার আজও বলেন-
“আমার স্বামীর কথা কেউ বলে না। কারণ তিনি ছাত্র ছিলেন না, শ্রমিক ছিলেন।”

প্রতিরোধের ইতিহাসে শ্রমিকরাও শহীদ
গণঅভ্যুত্থান এক শ্রেণির নয়-সব শ্রেণির মানুষের রক্তে গড়া। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে নয়, গুলিবিদ্ধ হয়েছে ফুটপাতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দিনমজুর, রিকশাচালক, দোকান কর্মচারীও। শহীদ ফারুক সেই শ্রমজীবী বাংলাদেশির প্রতীক-যার নামে নেই স্মৃতিসৌধ, নেই কোনো গেজেট, নেই কোনো সরকারি ঘোষণাপত্র।

আজ আমরা দাবি জানাই-
শহীদ ফারুক সহ সব আহত ও নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা চব্বিশে জুলাই বিপ্লবের শহীদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

সরকারি গেজেট প্রকাশে যেন কাউকে বাদ না দেওয়া হয়-বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষদের।
গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা ইতিহাসে কাউকে ফেলে আসতে চাই না

গণঅভ্যুত্থান যদি সত্যিই গণমানুষের হয়, তাহলে সেখানে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক-সবাই সমান। শহীদের মর্যাদায় শ্রেণি থাকতে পারে না। ফারুকের নাম ইতিহাসে উঠে আসুক-শুধু একজন শ্রমিক নয়, একজন প্রতিরোধের সৈনিক হিসেবে।
আমরা ভুলে গেলে চলবে না-
“ফারুকের হাত তখনও পুরোপুরি মুছা হয়নি-তার আগেই গুলিতে ঝরে পড়ে ছিলো এক বিপ্লবের রক্ত!”
লেখক:সম্পাদক – নবজাগরণ।
জুলাই যোদ্ধা- আহত সাংবাদিক
বিস্তারিত জানতে পড়ুন শেয়ার করুন :
www.thenabajagaran.com