শিশু উম্মে হাবিবার পানিতে পড়ে যাওয়া আর একটি রাজনৈতিক মিথ্যার অবসান: জামায়াতের মানবিক উদ্যোগ ও আমাদের বিকৃত চেতনার প্রশ্ন

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী :
গতকাল ২০ জুলাই নোয়াখালীর সেনবাগ পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের কালীগঞ্জে একটি ছোট শিশুর কান্না যেন গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দিল। মাত্র পাঁচ বছরের উম্মে হাবিবা একটি ভাঙাচোরা সাঁকো পার হতে গিয়ে পড়ে গেল পানিতে। ভাগ্য ভালো, এক পথচারী মুহূর্তে তাকে উদ্ধার করেন এবং হাসপাতালে নিয়ে যান। এই ঘটনা হয়তো প্রতিদিনকার কোনো দুর্ঘটনা হিসেবেই হারিয়ে যেত, যদি না এই ছোট্ট শিশুটির বিপদের খবর পৌঁছে যেত সেনবাগ পৌর জামায়াতের সভাপতি আলাউদ্দিন আলোর কাছে। খবর পেয়েই তিনি ছুটে যান ঘটনাস্থলে, পরিদর্শন করেন সাঁকোটি এবং সিদ্ধান্ত নেন-এই ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকোটি নতুনভাবে তৈরি করে দেবেন।

পরদিন, ২১ জুলাই সোমবার, কথামতো কাজ করে দেখালেন। জামায়াতে ইসলামীর যুব শাখার স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি হয়ে গেল নতুন সাঁকোটি। বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন পৌর জামায়াতের আমির মাওলানা ইয়াসিন মিয়াজী।এ ঘটনায় আমি বিষ্মিত হয়েছি এমনটা সম্ভব! হাঁ-দেশপ্রেম সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে অসম্ভব বলতে কিছুই নেই।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে-এই মানুষগুলোর পরিচয় কী?
এরা সেই ‘জামায়াত’ নামক রাজনৈতিক দলের সদস্য, যাদের গায়ে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীর তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। এদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে মিডিয়ায়, নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছাত্র রাজনীতিতে, বঞ্চিত রাখা হয়েছে গণতন্ত্রের সর্বশেষ ছিটেফোঁটাও থেকে। অথচ গ্রামের ভাঙা সাঁকো পেরোতে গিয়ে যখন কোনো শিশু পানিতে পড়ে যায়, তখন রাজনীতির বড় বড় বুলি আওড়ানো দলগুলোর কেউ এগিয়ে আসে না। তখন এগিয়ে আসে এই ‘নিষিদ্ধ’, ‘ঘৃণিত’ বলে চিত্রিত মানুষেরাই।

জামায়াতকে নিয়ে আমাদের সমাজে একটি গভীর আত্মপ্রতারণার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ক্ষমতার প্রয়োজনে, সরকার গঠনের প্রয়োজনে বারবার তাদের হাতে হাত রাখে বড় বড় দলগুলো। সংসদ গঠন, বাজেট পাশ, এমনকি রাষ্ট্রপতির ভোট পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে তাদের সমর্থন নিয়ে। অথচ যখন সেই প্রয়োজন ফুরায়, তখনি শুরু হয় ‘রাজাকার তাড়াও’ নাটক। জামায়াত যেন রাজনৈতিক লাশ-চাহিদা অনুযায়ী টেনে আনা হয়, আবার প্রয়োজনে দাফন করা হয় অপপ্রচারের কবরখানায়।

তবে বাস্তবতা ভিন্ন। জামায়াত কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি সামাজিক সংগঠনও বটে। তাদের নেতা-কর্মীরা এদেশের প্রতিটি অঞ্চলে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তারা গ্রামে যায়, যেখানে শহুরে রাজনীতি কখনো পৌঁছায় না। তারা রমজানে রিকশাওয়ালার হাতে খাবার তুলে দেয়, বন্যায় গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, দুঃখে-দুর্দশায় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য করে-নির্বিচারে, নিঃস্বার্থে।

উম্মে হাবিবার সাঁকোটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল-রাজনীতি মানেই টকশো নয়, রাজনীতি মানে হচ্ছে মানুষের পাশে থাকা। আর এই কাজটি এখন করে দেখাচ্ছে যাদের আমরা ‘নিষিদ্ধ’ বলি, যাদের সন্তানদের পর্যন্ত পাসপোর্টে ‘অযোগ্য’ লেখা হয়!

জামায়াত কি শুধুই ইতিহাসের ভুল?
এই প্রশ্ন আমাদের মনকে নাড়া দেয় না, কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও রাজনীতি আমাদের চেতনার ওপর একটি পর্দা ফেলে রেখেছে। বাস্তবতা হল, জামায়াত রাষ্ট্র শাসনের স্তর থেকে শুরু করে গ্রামের গরিব ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুর নাম রাখার মতো ঘরোয়া সিদ্ধান্তেও decades ধরে উপস্থিত। কেউ পছন্দ করুক বা না-ই করুক, তারা এ দেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামোর একটি, যা ১৯৭১ সালের বিতর্ক পেরিয়েও মানুষের সেবায় নিজের অবস্থান প্রমাণ করছে।

যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, গায়েবি মামলা, নিষেধাজ্ঞা-এসবই একদলীয় শাসনের ছদ্মবেশ। যেসব দল জামায়াতের সাথে এক মঞ্চে রাজনীতি করেছে, তাদের মুখে এই যুদ্ধাপরাধের বুলি আর চলে না। বরং প্রশ্ন উঠতেই পারে-জামায়াত যদি এতই খারাপ হয়, তাহলে তাদের ঘাড়ে ভর দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বড় দলগুলোর অবস্থান কী?

উম্মে হাবিবার ভেজা কাপড়ের মতো কাঁপতে থাকা ছোট্ট শরীর আমাদের মনে করিয়ে দেয়-রাজনীতি মানে শুধু ‘অবৈধ অর্থ’ নয়, রাজনীতি মানে মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়া। সেনবাগের সেই সাঁকো যেন পরিণত হয়েছে একটি আদর্শের প্রতীকে-সত্যিকারের দেশপ্রেম কী, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

এখন সময় এসেছে পুরনো প্রপাগান্ডার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার। সময় এসেছে বিচার করার কাজটি জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়ার। মানুষ জানে কারা শুধু মুখে আদর্শের বুলি আওড়ায়, আর কারা গোপনে জনগণের ঘাম মুছে দেয়। সেনবাগের এই সাঁকো সেই সাহসী বাস্তবতা-যা একদিন হয়তো আমাদের জাতীয় সাঁকো হয়ে উঠবে, বিভেদের জল পেরিয়ে ঐক্যের পাড়ে পৌঁছাতে।

লেখক :সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ
জুলাই যোদ্ধা-আহত সাংবাদিক।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন শেয়ার করুন অনলাইনে পড়তে :
www.thenabajagaran.com