নবজাগরণ প্রতিবেদন:বিশেষ অনুসন্ধান-ঢাকা-নোয়াখালী
ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় সম্প্রতি যে চাঞ্চল্যকর চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে, সেটি যেন একালের প্রতারণার প্রতিচ্ছবি। যে রিয়াদ এক সময় দিনমজুর, রিকশাওয়ালার ঘরের সন্তান-সে-ই কিনা আজ কোটি টাকার সাম্রাজ্যের মালিক, সমাজসেবী ছদ্মবেশে সাবেক সংসদ সদস্যের কাছ থেকে দাবি করে বসেছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা!
আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো-এই কাণ্ডের মূলহোতা আব্দুর রাজ্জাক সোলায়মান ওরফে রিয়াদ নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার ৯ নম্বর নবিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। এলাকাবাসীর চোখের সামনেই ঘটেছে তার বিত্তবৈভবের বিস্ফোরণ। অথচ কেউ জানতো না-এর পেছনে আছে ভয়ানক প্রতারণার জাল, ছদ্মবেশী ‘আন্দোলনের’ নামে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের কৌশল।
ছাত্রনেতা না চাঁদাবাজ?
রিয়াদ নিজেকে পরিচয় দেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠনের ঢাকা মহানগরের সিনিয়র সংগঠক হিসেবে। বাস্তবতা হলো-এই সংগঠনের কোনো নিবন্ধন নেই, কার্যকর কাঠামো নেই, কোনো সরকারি স্বীকৃতিও নেই। তদন্তে জানা গেছে, এটি ছিলো মূলত ভয়ের কৌশল-“আমরা পদযাত্রা করব, প্রতিবাদ করব, গণমাধ্যমে নাম ছড়াব”-এই ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন এলাকায় গিয়েই আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের চাঁদা।
হাতেনাতে ধরা, ধরা পড়লো বাস্তব ‘চরিত্র’
২৬ জুলাই বিকেলে গুলশান থানা পুলিশ সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় গিয়ে হাতেনাতে আটক করে রিয়াদসহ ৫ জনকে। পুলিশ জব্দ করে-
ভুয়া রশিদ বই
বানানো পরিচয়পত্র
মোবাইল ফোন
৫০ লাখ টাকার চাঁদা তোলার পরিকল্পনা সম্বলিত তালিকা
বাড়ির কর্তৃপক্ষ প্রথমে সন্দেহ প্রকাশ করলেও, পুলিশের হস্তক্ষেপে পুরো ষড়যন্ত্রের জাল ফাঁস হয়ে যায়
দিনমজুরের ঘরে কোটিপতির উত্থান: সন্দেহের ছায়া
সেনবাগের নবিপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে বেপারী বাড়ির ছেলে রিয়াদ মাত্র এক বছর আগেও ছিলেন একেবারেই সাধারণ। পরিবারে ছিলো রিকশা চালিয়ে সংসার টানার বাস্তবতা। অথচ গত এক বছরে দৃশ্যপটে এসেছে-
দামি ব্র্যান্ডের পোশাক
নবীপুরে ডুপ্লেক্স বাড়ি
লাখ টাকার গরু দিয়ে একক কোরবানি
স্থানীয়ভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ
এলাকাবাসী প্রশ্ন তুলেছেন, “কোন ব্যবসা বা চাকরি ছাড়াই এই অর্থ কোথা থেকে?”
রাজনৈতিক মদদ আছে?
তদন্তকারী সংস্থাগুলোরও ধারণা-এই ধরনের প্রতারণা কেবল রিয়াদ একা করেনি। এর পেছনে থাকতে পারে-
কোনো রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা
বিত্তবান অর্থদাতাদের মদদ
একটি সংগঠনের নামে চাঁদাবাজির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো-‘আন্দোলন’ নাম করে ত্রাস সৃষ্টি, তারপর সমাজসেবার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। চক্রটি এর আগেও একাধিক এলাকায় এই কৌশলে চাঁদা তুলেছে বলে জানিয়েছে গুলশান থানা পুলিশ।
সামাজিক প্রতিরোধ ও তদন্তের দাবি
স্থানীয়রা বলছেন-
“আমরাই তো বারবার বলেছি,রিয়াদের এই উত্থান স্বাভাবিক নয়। আজ প্রমাণ মিলেছে।”
“ওদের মতো প্রতারকরা সমাজের বিশ্বাস ভাঙে,প্রকৃত ছাত্রনেতাদের মুখ পুড়ায়।”
তাদের দাবি-
১. রিয়াদের সম্পদের উৎস তদন্ত করা হোক
২. চক্রের পেছনের অর্থদাতাদের খুঁজে বের করা হোক
৩. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামধারী সব ভুয়া সংগঠনের আইনি বৈধতা খতিয়ে দেখা হোক
৪. চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনকল্যাণে ব্যবহার হোক
আমরা কোন সমাজে বাস করছি?
আজকের বাংলাদেশে একজন রিকশাচালকের ছেলে এক বছরের মধ্যে কোটিপতি হয়ে গেলে আমরা তা উৎসব হিসেবে দেখি, কিন্তু তার উৎস যদি হয় ভুয়া পরিচয়, চাঁদাবাজি ও প্রতারণা-তবে সেটি সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর বার্তা।
এই রিয়াদ একা নয়-সম্ভবত আরও অনেক রিয়াদ আমাদের সমাজে ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে।
প্রতিবেদকের ভাষ্য:একজন প্রতারকের চমকপ্রদ উত্থান যে সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে-রিয়াদের ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এখন সময় হয়েছে, মুখোশ খুলে দেওয়া,প্রতারণার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার।