তারা চাচার খোলা চিঠি-৩

তারা চাচার খোলা চিঠি-৩

প্রাপক: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস
প্রেরক: তারা চাচা, গেরামের মাটির মানুষ
বিষয়: এই চাঁদাবাজির রাজত্ব কবে শেষ হবে?

চাচা,সালাম নিন।
আপনে এখন এই অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল কর্ণধার। আমরা গরিব-গুর্বো মানুষরা আজকাল আর এমপি-মন্ত্রীর মুখ চেয়ে থাকি না-আপনের মতো একজন বিবেকবান, ন্যায়পরায়ণ মানুষের দিকেই তাকাই।
তাই এই চিঠি-এই গেরামের হোগলার পাটিতে বসে, আশপাশে ছাগল-গরু ঘুরে বেড়ায়, আর কাঁদা মাখা পায়ে দুইটা শিশু পাশ দিয়ে দৌড়ায়।

চাচা, এই চাঁদাবাজি আর দুর্নীতির রাজত্ব কবে শেষ হবে?
এই প্রশ্ন এখন শুধু আমার না। এই কথাই বলছেন ডা. তাসনিম জারা, জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব।
তাঁর ভাষায়:

“অপরাধী যেই হোক, পরিচয় বা অতীত ইতিহাস যা-ই হোক, সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে কিছুই বদলাবে না।”

তিনি আরও লিখছেন-রাজবাড়ী থেকে খুলনা, পঞ্চগড় থেকে ভোলা পর্যন্ত ঘুরে দেখেছেন, প্রতিটি প্রান্তের মানুষ একটাই কথা বলছে:
“এই চাঁদাবাজি আর দুর্নীতির রাজত্ব কবে শেষ হবে?”

গেরামের বাস্তবতা শুনেন চাচা:
সেনবাগের এক আহত সাংবাদিক, যে জুলাই বিপ্লবের সময় গুলি খেয়েছে, মাথা ফেটেছে দুহাত ভেঙেছে; রক্তাক্ত করেছে-তার নাম আজও এমআইএস তালিকায় ওঠেনি।
তৃতীয় পর্যায়ের গেজেটেও নাম আসেনি, কিন্তু চিকিৎসা সহায়তা তো দূরের কথা,আজ পর্যন্ত কেউ খবর পর্যন্ত নেয়নি ।

এই রাষ্ট্র কি কেবল গেজেট ছাপে, নাকি দরজায় তালা দেয়?

টঙ্গীতে এক বিধবা মহিলা খোলা ম্যানহোলে পড়ে মারা গেলেন।
তার যমজ শিশু চিৎকার করে “আম্মু! আম্মু!” বলে।
সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস আসে-তখনো বলে, “খোঁজ পাই নাই।”
সিটি কর্পোরেশন আগেই জানতো, ঢাকনার ওপরে ঢাকনা নাই। তবু তারা কিছু করেনি।
এই মৃত্যু কি নিছক দুর্ঘটনা? না রাষ্ট্রীয় অবহেলার ফল?

চাচা, এই অবিচারের শেষ কোথায়?দায় কার?
আমরা যারা গেরামের মানুষ-আমাদের একটাই অপরাধ: আমরা গরিব।
আমরা শুধু পেটি চাঁদাবাজ আর স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শিকার না-আমরা এই রাষ্ট্রেরও অবহেলার শিকার।
যে বিধবা মা রাস্তায় মরল, তার যমজ সন্তানের কান্নার দায় কেউ নেয় না।

এ কেমন রাষ্ট্র, চাচা?
আপনি তো ইউনূস সাহেব-শান্তির নোবেল বিজয়ী।
আপনি জানেন উন্নয়ন মানে কেবল অর্থ নয়-উন্নয়ন মানে মানবতা, ন্যায়বিচার, গরিবের কথা বলার সাহস।
আপনি এখন এই রাষ্ট্রের অন্তর্বর্তী প্রধান উপদেষ্টা।
ইতিহাস আপনাকে প্রশ্ন করবে-আপনি এইসব অবিচারের পাশে দাঁড়ালেন, না চুপ করে থাকলেন?

তারা চাচার দাবি:
১. জুলাই বিপ্লবের আহত সাংবাদিকের নাম এমআইএস তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন গেজেট প্রকাশ করুন ।
২. টঙ্গীর মৃত্যুর ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনুন।
৩. দলের মুখ না দেখে সব চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজকে বিচারের আওতায় আনুন।
৪. গরিব ও প্রান্তিক মানুষের আবেদন যেন আর অবহেলার শিকার না হয়-আপনার নেতৃত্বে এই পরিবর্তন ঘটুক।

বিশেষ ধন্যবাদ:
চাচা,গতকাল আপনি জাতীয় পরিষদে দাঁড়িয়ে বলেছেন-চাঁদাবাজরা কোনো দলের নয়, এই অপরাধ পুরনো এক আইনের ফাঁক গলে চলছিল, তাই আপনি আইন সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন।
আমরা আপনার এই অবস্থানকে সাধুবাদ জানাই।

এটাই তো আমরা চাই-যেখানে অপরাধীর পরিচয় নয়, অপরাধই মুখ্য হয়।
আপনার এই সাহসী অবস্থান দেখে আমরা আশাবাদী হই, সাহস পাই।

পরিশেষে বলতে চাই-চাচাগো
আমরা আর কাঁদতে চাই না-আমরা লিখতে চাই।
এই চিঠিগুলোর ভাষা যেন আর আর্তনাদ না হয়-হোক সত্যের আওয়াজ।
এমন রাষ্ট্র গড়েন, যেখানে কোনো শিশু খোলা ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে “আম্মু” না খোঁজে,
এমন রাষ্ট্র গড়েন, যেখানে একজন সাংবাদিক চিকিৎসার জন্য হাত না পাতে।

চাচাগো আরো একটা কথা বলতে চাই-
উন্নয়ন মানে শুধু বোয়িং কেনা নয়-আকাশ প্রতিরক্ষাও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অংশ

চাচা,
এই রাষ্ট্র যদি সত্যিই “স্মার্ট বাংলাদেশ” হতে চায়, তাহলে শুধু আকাশে উড়ার ভাবনা নয়, আকাশ রক্ষা করার সাহসও চাই।
শুধু বোয়িং কিনলেই জাতি উন্নত হয় না-যখন নিজের আকাশও সুরক্ষিত থাকে, তখনই প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।

এই যে সরকার ২৫টি বোয়িং কেনার কথা বলছে, সেটি প্রশংসনীয় –
তবে এই ৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ একতরফা হলে তা হবে একপেশে কৌশলহীন সিদ্ধান্ত।

চাচা, একটু ভাবেন- ১টা বোয়িং এর দাম যেখানে ২৮০ মিলিয়ন ডলার,
সেখানে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Iron Dome, Patriot, S-350) একটা দেশে শুধু প্রতিরক্ষা না-শিল্প, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার ট্রান্সফার দেয়।

ইসরায়েল আয়রন ডোম বানিয়ে শুধু হামলা ঠেকায় না, তারা সেই প্রযুক্তি রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করছে।
ভারত শুধু যুদ্ধবিমান কেনেনি, তারা S-400 মিসাইল সিস্টেম নিয়েছে। একদিকে আকাশ রক্ষা, অন্যদিকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো।
আর আমরা? শুধু প্লেন কিনে বিদেশি কোম্পানির উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছি।

চাচা,
বাংলাদেশের বর্তমান নিরাপত্তা বাস্তবতা বলছে-
সীমান্তে অস্ত্র চোরাচালান
বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত চাপ
সাইবার হুমকি

রূপপুর, ঘাঁটি, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনেক কৌশলগত স্থান এখন ঝুঁকিপূর্ণ
এই অবস্থায়, ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করলে যদি অন্তত ৫ বিলিয়ন দিয়ে ১০-১৫টি আয়রন ডোম, ২-৩টি স্টেট-অফ-দ্য-আর্ট রাডার সিস্টেম, MALE ড্রোন ও সাইবার কমান্ড গঠন করা যায়-তাহলে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

শুধু নিরাপত্তা নয়, প্রযুক্তি হস্তান্তর, গবেষণা উন্নয়ন, নতুন কর্মসংস্থান, প্রতিরক্ষা শিল্প বিকাশ-সবই সম্ভব।এ অধম গেরামের কাঁদা মাখা সরু রাস্তা মোটা ভাত ছাড়া ওতশত বুজি কম-চাচা।
তারা চাচার বার্তা হোক নতুন রাষ্ট্রদর্শনের সূত্রপাতঃ
জনগণের নিরাপত্তা মানে শুধু বন্দুকধারী পাহারাদার না, বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি শিশুর জন্য নিরাপদ রাস্তা, নিরাপদ ভবিষ্যৎ।

উন্নয়ন মানে শুধু আকাশে উড়ার সক্ষমতা না, বরং আকাশ পাহারা দেওয়ার সক্ষমতা।
অর্থনীতি মানে শুধু জিডিপি নয়, বরং গরিবের চিকিৎসা, মায়ের কান্না, সাংবাদিকের সুরক্ষা।

চাচা, আপনি সাহস করেছেন চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে। এবার সাহস দেখান নতুন বাজেট দর্শনের ক্ষেত্রেও।
দেশের প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি ও মানবিক উন্নয়ন যেন হাতে হাত রেখে এগোয়-এই হোক আগামী দিনের রাষ্ট্রচিন্তা।

আপনার পেছনে আমরা আছি- গেরামের মাটি মাখা সত্য, শহরের ব্যথিত বিবেক, আর আগামী প্রজন্মের কান্না নিয়ে।
আপনার দিকে চেয়ে আছি চাচা,
কারণ আপনি শুধু সরকারের প্রধান উপদেষ্টা না,
এখন আপনি জনগণের বিবেক।

ইতি,
তারা চাচা
গেরামের এক মাটি মাখা মানুষ
(পেছনে ছাগল দৌড়ায়, গরু ঘাস খায়,মাঝি নৌকা চালায় আর আমি কলম চালাই।)