নবজাগরণ ডেস্ক:
সন্তান তার বৃদ্ধা মাকে কাঁধে করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে পলায়ন করছে। সময়টা অক্টোবর ১৯৭১। ভারতীয় সীমান্তের বনগাঁও পেরিয়ে শরণার্থী শিবিরের পথে কয়েক পা মাত্র। মায়ের বয়স তখন ৯৯ বছর, ছেলের বয়স ৬৩। মা হাটতে পারেন না, সন্তান তাঁকে কোলে তুলে নিয়েছেন। আর সেই মুহূর্তেই ক্যামেরার লেন্সে ইতিহাস হয়ে ধরা পড়লেন তাঁরা-ছবিটি তুলেছিলেন ফটোসাংবাদিক সন্তোষ বাসাক। এই ছবিটি শুধু এক মুহূর্তের নয়, এটি একটি জাতির সংগ্রাম, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ আর আত্মত্যাগের প্রতীক।
এটি ছিল নিছক একটি মা ও ছেলের কাহিনি নয়-এ ছিল ৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন আর বিভীষিকার হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে লাখো শরণার্থীর ভারতে পলায়নের প্রতিচিত্র। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটির বেশি মানুষ তখন ভারতের দিকে পলায়ন করেছিল-মাথায় বস্তা, কাঁধে শিশু, কোলে পঙ্গু মা, পেছনে পুড়ে যাওয়া ঘর, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
এমন একটি ছবি বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। যুদ্ধ আর মানবতার সীমান্ত কোথায়, সেই প্রশ্ন তুলেছিল এই অসাধারণ চিত্র। এজন্যই এই ছবি World Press Photo ১৯৭২-এর শ্রেষ্ঠ ছবির মর্যাদা পায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-আমরা, যারা এই ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করি, আমরা কি এই ছবির দায়ও বহন করছি?
এক ইতিহাসের মুখোমুখি-
ছবিটি আমাদের সরাসরি মুখোমুখি দাঁড় করায়-৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নয়, ছিল মানবিক বাঁচার আকুতি, ছিল নিজের মা-বোনদের রক্ষার যুদ্ধ, ছিল অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের এক নিঃশব্দ দলিল হয়ে আছে এই ছবি। একটি ৯৯ বছরের নারী, যিনি হয়তো নিজে বুঝতেও পারছিলেন না কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, তবু তাঁর সন্তান জানতেন-“আমি তাঁকে ফেলে রেখে কোথাও যাবো না। কারণ, তিনিই আমার মা।”
আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নগুলো আবারও ফিরে আসে:
যারা আজও বাস্তুহারা-তারা কী ৭১-এ আমাদের মা নয়?
যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটায়-তারা কি সেই বৃদ্ধার মতো নয়, যাদের কোলে তুলে নেওয়ার কেউ নেই?
আমরা কি এই জাতিকে মা মনে করি? নাকি শুধু ভোটের খেলার ঘুঁটি?
জাতীয় চরিত্রের আয়না-
এই ছবিটি আমাদের কেবল আবেগে গদগদ করে না; এটি একটি আয়না-যেখানে আমরা দেখতে পাই আমাদের জাতীয় চরিত্র, আমাদের আত্মপরিচয়। মুক্তিযুদ্ধ কি কেবল রাইফেল হাতে যুদ্ধ করার নাম? নাকি নিজের অসুস্থ, অচল মাকে বহন করার মানসিকতা, ভালোবাসা, দায়িত্ব-এটাই মুক্তিযুদ্ধ?
আজ যখন রাষ্ট্র মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, সন্তান যখন নিজের ব্যস্ত জীবনের অজুহাতে পিতা-মাতাকে ফেলে রাখে, তখন এই ছবিটি হয়ে ওঠে এক তীব্র প্রতিবাদ, এক নীরব চিৎকার।
সেই চিৎকার বলে-
“এই দেশ মায়ের মতো, তাকে কাঁধে নেওয়ার দায় তোর আছে, ভাই। পেছনে ফেলে নয়-সামনে নিয়ে চলতে হয়।”
ছবি থেকে বিপ্লবের আহ্বান-
এই ছবিটি এখন আর শুধু একটি ঐতিহাসিক দলিল নয়। এটি একটি বিপ্লবের হাতিয়ার। রাষ্ট্র যদি মা হয়, তবে তার সব সন্তানকে কোলে নিতে হবে-যে মেধাবী ছাত্র পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করে, যে নারী গ্রামে থেকে সুযোগ পায় না, যে শ্রমিক পরিবার থেকে আসা তরুণ চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসে ঠাঁই পায় না-সবার জন্য রাষ্ট্রকে মা হতে হবে। এবং আমাদের সবাইকে সেই ৬৩ বছরের সন্তানের মতো হতে হবে-নিজের মাকে ফেলে রেখে না যাওয়া, মাকে কোলে নেওয়ার দায় নিয়ে চলা সন্তান।
‘বাস্তুহারা’ ছবির ৯৯ বছরের মা ও ৬৩ বছরের ছেলের মুখ আমাদের দিকে চেয়ে আছে। তারা কোনো বক্তব্য দেয় না, কোনো আবেদন রাখে না-তারা কেবল চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করে:
“তোমরা কি এখনো আমাদের কথা মনে রাখো? আমরা তো সব হারিয়েও দেশটাকে ভালোবেসেছিলাম। তোমরা কী করছো সেই দেশের জন্য?”
এই প্রশ্নের উত্তর যদি সত্যিই দিতে হয়, তাহলে কেবল ফুল দিয়ে শহীদ মিনার ভরিয়ে নয়-আমাদের প্রত্যেককে হতে হবে সেই ছেলের মতো। যে নিজের মাতাকে কাঁধে নিয়ে পাড়ি দেয় রক্তাক্ত সীমান্ত, শুধু একটি কারণেই-“উনি আমার মা।”
নবজাগরণ-এর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা সেই মাতা ও সন্তানের প্রতি। শ্রদ্ধা সেই যুদ্ধাহত, পীড়িত, ভ্রষ্ট, বিধ্বস্ত মাতৃভূমির প্রতিও, যাকে আজো অনেকেই কোলে তুলে নিতে রাজি নয়।