নবজাগরণ ডেস্ক:
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয়করিতার দুঃশাসন, প্রশাসনের উপর দখলদারিত্ব ও সংসদের একতরফা নিয়ন্ত্রণের যুগ পেরিয়ে বাংলাদেশ নতুন এক গণতান্ত্রিক যাত্রার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। দেশের জনগণের দাবি ও আন্দোলনের মুখে সরকার সম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে-১০০ আসনের একটি ‘উচ্চকক্ষ’ (Upper House) গঠনের ঘোষণা এবং সেখানে Proportional Representation (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন-তা নিঃসন্দেহে জনগণের আরেকটি বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
PR পদ্ধতি কী?
PR বা Proportional Representation এমন একটি নির্বাচনী পদ্ধতি যেখানে দলগুলো মোট প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন পায়। অর্থাৎ ৩০% ভোট পেলে ৩০টি আসন, ১০% পেলে ১০টি আসন। এতে বড় দলগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে, ছোট দল ও বিকল্প কণ্ঠস্বরের জন্য বাস্তবিক সুযোগ সৃষ্টি হয়।
PR পদ্ধতির সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাব:
১. জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন
পিআর পদ্ধতিতে একটি দল ১০% ভোট পেলেও সে প্রতিনিধিত্ব পাবে, যা আগে কখনো সম্ভব হতো না। অর্থাৎ প্রতিটি ভোট মূল্যবান হয়ে উঠবে, এবং দেশের বাস্তব রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব মিলবে উচ্চকক্ষে।
২. ছোট দল ও স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের উত্থান
বড় দুই দলের বাইরেও যারা দেশ নিয়ে ভাবছে-পরিবেশবাদী, প্রগতিশীল, শ্রমিক, নারী, আদিবাসী, যুব, শিক্ষানীতি, কিংবা দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম-এরা প্রথমবারের মতো শক্ত অবস্থান নিতে পারবে।
৩. দ্বিদলীয় দুঃশাসনের অবসান
দুই দলের মধ্যে ‘পাস দ্যা পাওয়ার’ খেলা ভেঙে দিয়ে জনগণ নতুন ধরনের জবাবদিহিমূলক ও সম্মিলিত সিদ্ধান্তগ্রহণের পরিবেশ পাবে।
৪. আইন প্রণয়নে ভারসাম্য ও পর্যালোচনা
উচ্চকক্ষে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি থাকায় একতরফাভাবে আইন পাশ করানো কঠিন হবে। এতে সংসদের দ্বিকক্ষ বিশিষ্টতা বাস্তব অর্থে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও নেতিবাচক দিক:
১. দলীয় প্রভাব এবং মনোনয়ন বাণিজ্য
পিআর পদ্ধতিতে যদি দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনোনয়ন দেয়, তাহলে সেখানে ঘুষ, চাটুকারিতা, গোষ্ঠীবাদ ঢুকে যেতে পারে। এজন্য প্রার্থী বাছাইয়ের স্বচ্ছ ও জনভিত্তিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
২. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জোট সরকার
অনেক দল সংসদে আসলে সরকার গঠন বা আইন পাশ করাতে জোট দরকষাকষি বাড়বে, যা নীতিনির্ধারণে ধীরগতি আনতে পারে।
৩. জবাবদিহির অভাব
পিআর-এ নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় প্রার্থী নির্বাচিত না হওয়ায়, জনগণ কার কাছে জবাব চাইবে-এ প্রশ্ন তৈরি হয়। এর সমাধানে প্রার্থীদের জেলা-আঞ্চলিক সংযোগ রাখতে হবে।
এই পদ্ধতি কার্যকর করতে হলে কী প্রয়োজন?
স্বচ্ছ দলীয় মনোনয়ন পদ্ধতি
আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোর বিকাশে সহায়তা
প্রতিনিধিদের নিয়মিত জনগণের মুখোমুখি হওয়ার বিধান
পিআর ভিত্তিক আসনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচনী তদারকি
ভবিষ্যতের জন্য বার্তা:
এই পিআর পদ্ধতি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশে দলতন্ত্র থেকে জনগণতন্ত্রে উত্তরণের পথ সুগম হবে। এটি হবে এক ধরনের ‘গণতন্ত্রে গণমানুষের পুনরাগমন’যেখানে আর কেউ ভোটের বাইরে থাকবে না।
আমরা আশাবাদী, এই উচ্চকক্ষ ও পিআর পদ্ধতি একদিন এমন একটি অবস্থান গড়ে তুলবে যেখানে একজন পরিবেশকর্মী, একজন শ্রমিকনেতা, একজন আদিবাসী নারী, কিংবা একজন তরুণ উদ্যোক্তাও জাতীয় সংসদের মঞ্চে রাষ্ট্রপতির ভাষণের জবাব দিতে পারবেন।
এগিয়ে যাও, বাংলাদেশ।
জনগণের প্রতিনিধি যেন হয় জনগণেরই মুখপাত্র-এই হোক গণতন্ত্রের আসল চেহারা।
১০০ আসনের পিআর ভিত্তিক উচ্চকক্ষ গঠনের পথে বাংলাদেশ: কী আছে সামনে?
গবেষণা ভিত্তিক পরিসংখ্যান
বাংলাদেশের সংবিধানিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় একটি বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সরকার প্রস্তাব করেছে সংসদে ১০০ আসনের একটি উচ্চকক্ষ (Upper House) গঠন, যেখানে সদস্য নির্বাচিত হবেন PR (Proportional Representation) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতিতে।
এই ঘোষণা ইতিমধ্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। কেউ বলছেন এটি গণতন্ত্রের বিস্তার, কেউ বলছেন নতুন ধরনের দলীয়করণ ও ক্ষমতার পুনর্বণ্টন। নবজাগরণ টিম খতিয়ে দেখেছে এর গবেষণা, ইতিহাস ও প্রভাব।
পিআর পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে?
PR পদ্ধতিতে দলগুলো তাদের মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন পায়। উদাহরণস্বরূপ:
দল প্রাপ্ত ভোট (%) আসন সংখ্যা (100)
দল A 40% 40
দল B 30% 30
দল C 15% 15
দল D 10% 10
স্বতন্ত্র/অন্যান্য 5% 5
এভাবে ভোটের সঠিক প্রতিফলন সংসদে দেখা যায়।
বিশ্বের কোথায় কোথায় পিআর পদ্ধতি আছে?
জার্মানি: সংসদের নিম্ন ও উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি কার্যকর। ফলে পরিবেশবাদী ও শ্রমিক দলগুলোর অংশগ্রহণ সম্ভব হয়েছে।
নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড: সম্পূর্ণ পিআর ভিত্তিক নির্বাচন হয়। এ দেশে নারী, সংখ্যালঘু ও নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের জন্য ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
ভারত: রাজ্যসভায় সদস্য নির্বাচনে আংশিকভাবে পিআর পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় (STV – Single Transferable Vote)।
নেপাল: সংসদের একটি বড় অংশ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। ২০১৫ সালের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যালঘু, নারী ও দলিত সম্প্রদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট সংরক্ষণ রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিকতা:
দেশে বর্তমানে ৪২টির বেশি রাজনৈতিক দল রয়েছে, কিন্তু গত তিনটি সংসদে ৯০%-এর বেশি আসন দুই দলের নিয়ন্ত্রণে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে মাত্র ২টি দলই সংসদে স্থান পায়, বাকি সবাই কার্যত “ভোটারবিহীন” হয়ে পড়ে।
তরুণ ভোটার (১৮-৩৫) প্রায় ৪ কোটি, কিন্তু তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে।
নারী, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পরিবেশবাদী, শ্রমজীবী ও প্রতিবন্ধী নাগরিকদের কণ্ঠ সংসদে অনুপস্থিত।
পিআর পদ্ধতি এ সমস্যাগুলো লাঘব করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সম্ভাব্য সুফল:
১. বহুমতের প্রতিনিধিত্ব
পিআর পদ্ধতিতে ১০%-এর বেশি ভোট পেলে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়ায়, রাজনৈতিক বৈচিত্র্য প্রতিষ্ঠা পাবে।
২.সংসদে বিকল্প মতামতের প্রবেশ
কেবল সরকার ও বিরোধী দল নয়, থাকবে তৃতীয়, চতুর্থ কণ্ঠ-যা নীতিনির্ধারণে ভারসাম্য রক্ষা করবে।
৩. জাতীয় ঐকমত্য গঠনের পরিবেশ
একাধিক দলের উপস্থিতিতে সরকারকে বাধ্য করা হবে মতবিনিময় ও সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ:
মনোনয়ন বাণিজ্য:পিআর পদ্ধতিতে দলীয় তালিকা থেকে সদস্য নির্বাচিত হলে, দলীয় প্রধানরা পছন্দের লোক বসাতে পারেন, যদি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া না থাকে।
প্রশাসনিক জটিলতা:দ্বিকক্ষ সংসদে আইন পাশের প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে, এবং নীতি বাস্তবায়ন ধীরগতির হতে পারে।
দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় বিভক্ত উচ্চকক্ষ:প্রকৃত প্রতিনিধি না হয়ে ‘চাটুকার ও নিয়ন্ত্রিত সদস্য’ তৈরি হলে, উচ্চকক্ষ তার নিরপেক্ষতা হারাবে।
গবেষণা কী বলছে?
UNDP ও IDEA-এর যৌথ গবেষণা অনুযায়ী,পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া সংসদগুলোতে নারী সদস্যের সংখ্যা গড়তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা যায়,পিআর ভিত্তিক সংসদে দুর্নীতি কমে এবং বাজেটের স্বচ্ছতা বাড়ে।
দক্ষিণ এশিয়ায় পিআর ভিত্তিক উপাদান থাকলে সংখ্যালঘু ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
শুরু হোক গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন-
১০০ আসনের পিআর ভিত্তিক উচ্চকক্ষ বাংলাদেশের জন্য একটি গেম চেঞ্জার হতে পারে-যদি তা স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দলতন্ত্রের বাইরে গিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে।
নতুন উচ্চকক্ষ শুধুই একটি নতুন ঘর হবে না-এটি হতে পারে গণতন্ত্রে জনগণের ফিরে আসার ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।
প্রতিবেদন :মো:আবু তাহের পাটোয়ারী।