নবজাগরণ রিপোর্ট:
“গণতন্ত্রে গুলি চলে না। ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালালে সেটা আর রাষ্ট্র হয় না, সেটা একেকটা প্রতিষ্ঠিত খুনের মেশিনে রূপ নেয়।”
১৮ জলাই ২০২৪। সাভারে চলছিল ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। পুলিশি সাঁজোয়া যান (এপিসি) থেকে এক তরুণকে টেনে নামিয়ে, হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে গুলি চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তার নাম শাইখ আস-হাবুল ইয়ামিন-একজন মেধাবী ছাত্র, এমআইএসটির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, যিনি তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন নয়, এই দেশের গণতন্ত্রের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন।
তার মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেটি ছিল শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ নয়-সেটি ছিল রাষ্ট্রের নির্লজ্জ বর্বরতার অকাট্য দলিল। যারা চোখ বন্ধ করে রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়াতে চায়, সেই চোখে লাথি মেরে ঢুকে পড়েছিল ভিডিওটি। মানুষ দেখে ফেলেছিল রাষ্ট্রের খালি দাঁত-যেটা হেসে হেসে মানুষ খায়।
আজ সেই খুনি গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়-এত দেরি কেন?
প্রায় এক বছর পালিয়ে থাকার পর অবশেষে গ্রেপ্তার করা হলো সেই পুলিশ সদস্যকে-এএসআই মোহাম্মদ আলী। তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই দেশে বিচার কি কেবল ভিডিও ভাইরাল হলেই হয়? বিচার কি কেবল তখনই শুরু হয়, যখন প্রমাণ অস্বীকার করার উপায় থাকে না?
এএসআই মোহাম্মদ আলীর গ্রেপ্তার আমাদের বিজয় নয়, বরং আমাদের ব্যর্থতা-আমরা একটি সম্পূর্ণ বছরেরও বেশি সময় ধরে এক খুনিকে রক্ষা করতে থাকা রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে দিয়েছি মাত্র।
রাষ্ট্র যখন খুন করে,তখন ন্যায়বিচার হয় না-জলাঞ্জলি হয় বিচারব্যবস্থার।এই হত্যাকাণ্ড,এই গ্রেপ্তার,সবকিছু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ২০১৫ সালের লালবাগে তনু হত্যাকাণ্ডকে, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের রাতের বীভৎস নির্যাতনকে, অথবা ২০২১-এর সাংবাদিক মুশফিকের নিখোঁজ হওয়াকে। সব ঘটনা এক সুতায় গাঁথা-রাষ্ট্র যখন জনগণের প্রতিপক্ষ হয়, তখন তার হিংস্রতা আর গুপ্তচরবৃত্তি একাকার হয়ে যায়।
কে দেবে ইয়ামিনের মায়ের উত্তর?
গ্রেপ্তার তো হলো, কিন্তু ইয়ামিনের মা কি ফিরে পাবেন তাঁর সন্তানের প্রাণ? মেধাবী সেই তরুণ,যিনি এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠান এমআইএসটি-তে পড়তেন,যার স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক সফটওয়্যার প্রকল্পে নেতৃত্ব দেওয়া, সে কি এভাবেই একটি বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার জন্যই জন্মেছিল?
বিচার নয়, চাই কাঠামোগত বদল!
আজ আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানাচ্ছি, কিন্তু আসলেই কি বিচারের জন্য যথেষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে? পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ছাড়া, এপিসির মতো সামরিক সরঞ্জামের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন না তুলে, আন্দোলন দমনকে ন্যায্যতা দেওয়া আইনি কাঠামো না ভেঙে বিচার চাওয়া মানে হল রুগ্ন ব্যাধির উপর ব্যান্ডেজ লাগানো।
আমাদের এই বিচার চাইতে হবে একটি পূর্ণ সংস্কার ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে। এই হত্যার দায় শুধু এএসআই আলীর নয়-এই দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, পুলিশের প্রশিক্ষণ বিভাগের, আন্দোলনবিরোধী দমননীতির নীতিনির্ধারকদের।
জনগণের করণীয় কী?
১. স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করুন।
২. সব ভিডিওপ্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করুন।
৩. পুলিশ বাহিনীর অপব্যবহার, অস্ত্রের সীমা, ও দমননীতির ওপর পূর্ণ সংসদীয় শুনানি চাই।
৪. নতুন সংবিধানে নাগরিক নিরাপত্তার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা এবং রাষ্ট্রীয় হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক আইন অন্তর্ভুক্ত করুন।
ইয়ামিন শুধু একটি নাম নয়-এটা একটি ইতিহাসের মোড়।
একটি তরুণ প্রাণের হত্যাকাণ্ড আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়েছে। এখন ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। যতদিন না এই রাষ্ট্র একজন ছাত্রের চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, “তোমার জীবন এখানে নিরাপদ,” ততদিন প্রতিটি তরুণ-তরুণীই হুমকির মুখে। আর তাই, এটি শুধু বিচারের দাবি নয়-এটি একটি বিপ্লবের ডাক।