মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশেষ নিবেদন
“আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরা আমার- এগুলো বাংলাদেশের মানচিত্রে না আসা পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না।”
-মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী
এই একটি লাইনেই ফুটে ওঠে ভাসানী নামক এক রাজনৈতিক আগ্নেয়গিরির বিস্তৃতি। তিনি ছিলেন না কেবল এক অঞ্চলের নেতা-বরং ছিলেন এক জাতিসত্তার মুক্তির দূত। আজ ৩ আগস্ট ২০২৫, তাঁর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে যখন গোটা রাষ্ট্র নীতিহীনতায় ঠকঠক করে কাঁপছে, তখন এই প্রশ্নটা বারবার ফিরে আসে-ভাসানীকে আমরা বুঝতে পেরেছি তো?
কে ছিলেন মাওলানা ভাসানী?
তিনি ছিলেন-
উপমহাদেশের সবচেয়ে স্পষ্টভাষী রাজনৈতিক যোদ্ধা,
ধর্ম আর সমাজতন্ত্রের ঐক্যসূত্রে গড়া এক নতুন আদর্শের কণ্ঠস্বর, এবং সর্বোপরি,গরিব মানুষের পক্ষে কথা বলার শেষ সাহসী মুখ।১৯৫৭ সালে কাগমারীতে তিনি যে গণ-সম্মেলন করেন, সেখানে স্পষ্ট করে বলেছিলেন:
❝এই রাষ্ট্রব্যবস্থা শোষণমুখী-আমি এর বাইরে নতুন পথ খুঁজব।❞
এই ঘোষণার পর থেকে তিনি ছিলেন ক্ষমতার রাজনীতির চির-প্রতিপক্ষ।
চীন সফর ও পাকিস্তানের মঞ্চে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত
চীন সফর শেষে পাকিস্তানের এক শহরে নেমেছিলেন ভাসানী। পরনে লুঙ্গি, মাথায় তালপাতার টুপি। মেয়রের দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনার মঞ্চে ওঠার পর দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে কৌতূহলী গুঞ্জন:
-“ইয়ে তো মিসকিন হ্যায়…”
কিন্তু ভাসানী যখন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন, তখন তারা বলল-
– “ইয়ে তো মাওলানা হ্যায়…”
পরক্ষণেই যখন তিনি শোষণ, উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক বক্তব্য রাখলেন-
– “আরি বাহ্! ইয়ে তো পলিটিশিয়ান হ্যায়…”
আর যখন তিনি বিশ্ব শক্তির শোষণ ও বিশ্বমানবের মুক্তি নিয়ে কথা বললেন-
“হায় আল্লাহ! ইয়ে তো এস্টেটম্যান হ্যায়!”
এই ঘটনাটিই আসলে বলে দেয়,ভাসানী ছিলেন এক ব্যক্তি নন-এক যুগান্তকারী রাজনৈতিক দর্শন।
কেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন ভাসানী?
কারণ, তিনি ভূখণ্ডভিত্তিক স্বাধীনতাকে পূর্ণ স্বাধীনতা মনে করতেন না। কারণ, তিনি বলতেন-
❝স্বাধীনতা মানে কেবল পতাকা নয়, সেটা হতে হবে গরিবের ভাতের স্বাধীনতা,শ্রমিকের মজুরির স্বাধীনতা, কৃষকের জমির স্বাধীনতা।❞
কারণ, তিনি বলেছিলেন-
“আসাম, ত্রিপুরা,পশ্চিমবঙ্গ-এগুলোও আমার, কারণ বাঙালির ঐক্য কাঁটাতারে থেমে থাকতে পারে না।”
এই কথা কেউ সহ্য করতে পারেনি -না পাকিস্তানে, না স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বাধীনতা এল, ভাসানী কোথায়?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। সবাই যখন মন্ত্রীত্ব, দলে পদ আর গদির ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত, তখন ভাসানী ছিলেন কোথায়?
– তিনি ছিলেন সীমান্তে, ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে লংমার্চে।
– তিনি ছিলেন বন্যার্ত কৃষকের পাশে,
– তিনি ছিলেন চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায়,
– তিনি ছিলেন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সকল প্রান্তিক মানুষের ঐক্যের রাজনীতিতে।
এই জন্যই তাঁকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে বারবার। তাঁর নাম পাঠ্যবইয়ে নেই, তাঁর ছবি সংসদ ভবনে নেই, তাঁর চিন্তা দলীয় নেতাদের মুখে নেই।
এই প্রজন্মের জন্য ভাসানী কী বার্তা রেখে গেছেন?
১.রাজনীতি ক্ষমতার জন্য নয়-অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য।
২.ধর্ম ও সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব নয়- উভয়কেই গরিবের মুক্তির অস্ত্র বানানো যায়।
৩.স্বাধীনতা মানে কেবল ভূখণ্ড নয়-চেতনার পরিপূর্ণ মুক্তি।
আজ কেন আবার ভাসানী?
২০২৫ সালের বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৌলিক সংস্কার নানা ষড়যন্ত্র আন্দোলন বিচার ইস্যু নির্বাচন নিয়ে এক চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে ভাসানীর চেহারা আবার ফিরে আসে। তিনি যেন বলছেন-
❝আমি নেই, কিন্তু তোমরা তো আছো। তবে কবে রুখবে?❞
ভাসানী এখনও অপেক্ষা করছেন
আজ ৪৮ বছর কেটে গেছে। মাওলানা ভাসানী নেই, কিন্তু তাঁর মতো একটি সত্য স্পষ্ট, বিকল্পধারার নেতৃত্ব আজও বাংলাদেশ পায়নি।
তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাতে হলে ফুল না দিয়ে চাই-
শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠন
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাগরণ
এবং গরিব মানুষের পক্ষে স্পষ্ট রাজনৈতিক বিকল্প
ভাসানী মারা যাননি। ভাসানী অপেক্ষা করছেন-কারা আসবে শেষ বিদ্রোহটা শেষ করতে?
লেখক:সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ