নবজাগরণ রিপোর্ট:
আমরা,বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগণ-
যারা উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের গৌরবময় ধারাবাহিকতায়, পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম চালিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করি এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করি;
যারা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও একের পর এক স্বৈরতন্ত্র, দুঃশাসন,ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে গেছি;
আজ,৫ আগস্ট ২০২৪ সালে বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, জাতির ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, আমরা নিম্নলিখিত ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও ঘোষণা করছি:
প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা:
১। স্বাধীনতার মূল চেতনা-সাম্য,মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার-১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রতিফলিত হলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়।
২। ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য হরণ করা হয়, যার প্রতিক্রিয়ায় সিপাহী-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়।
৩। পরবর্তী সময়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বহুদলীয় গণতন্ত্রও বারংবার সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরাচার, নির্বাচনপ্রহসন ও বিদেশি প্রভুত্বের চাপে দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪। ১/১১-এর প্রেক্ষিতে,তথাকথিত দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের আড়ালে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে নতুন এক কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
৫। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশে একচ্ছত্র ক্ষমতা,দলীয়করণ, গুম-খুন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, মতপ্রকাশের দমন, বিচারব্যবস্থার অবমাননা এবং সংবিধানের অবৈধ পরিবর্তনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
৬। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রহসনমূলক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একদলীয় স্বার্থে কুক্ষিগত করা হয়।
৭। রাষ্ট্রীয় চাকুরিতে বৈষম্যমূলক কোটা,দুর্নীতিপরায়ণ নিয়োগ, মুক্তচিন্তার ওপর হামলা, ছাত্র ও তরুণদের দমন,এবং নাগরিক স্বাধীনতার ওপর অব্যাহত আগ্রাসনের ফলে সমাজে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
৮। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট সরকার নির্মম হামলা চালালে তা সর্বস্তরের জনগণের গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়।
৯। সেই অভ্যুত্থানে নারী-শিশুসহ সহস্রাধিক নাগরিক নিহত হন, অসংখ্য মানুষ আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন, যা ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায় হয়ে আছে।
১০। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের পক্ষে অবস্থান নেন, যার ফলে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে পদত্যাগ করতে এবং দেশত্যাগে বাধ্য হন।
১১। জনগণের সার্বভৌমতার ভিত্তিতে গঠিত নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটি গণমুখী,অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ঘোষিত অভিপ্রায়সমূহ:
১২। জনগণের এই বিজয় শুধু ফ্যাসিবাদ বিরোধী নয়, বরং একটি নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপান্তরের প্রত্যয়।
১৩। জনগণ প্রত্যাশা করে—
সকল মানবাধিকার লঙ্ঘন,গুম-খুন,দমন-পীড়নের নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচার হবে;
সকল শহীদকে‘জাতীয় বীর’হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে;
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের যথোচিত রাষ্ট্রীয় সম্মান ও সুরক্ষা প্রদান করা হবে;
বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক, সুশাসন নিশ্চিত একটি সমাজ বিনির্মাণ করা হবে;
পরিবেশ, জলবায়ু ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকারের সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করা হবে।
১৪। জনগণ প্রত্যাশা করে, যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে, যারা সংবিধানের সংস্কার সাধন করে এই ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের তফসিলে সংযুক্ত করবে।
১৫। জনগণ আশা করে-২০২৪ সালের “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান” রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই গণঅভ্যুত্থান থেকে গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা গ্রহণ করবে।
সুতরাং, ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী জনগণের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও ঘোষণা করা হলো।
“গণতন্ত্রের জয় হোক, ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটুক”
“শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ হোক রাষ্ট্রীয় ন্যায়ের মাধ্যমে”
“নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক জনগণের হাত ধরে”
ঘোষণাপত্র খসড়া চূড়ান্ত: নবজাগরণ নাগরিক পরিষদ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪-এর সমন্বয়কারী শক্তিসমূহের পরামর্শক্রমে।