নবজাগরণ রিপোর্ট:
শেষ ছবিটা যেন আজ গোটা বাংলাদেশকে কাঁদাচ্ছে।
নোয়াখালীর এক পরিবার-যাদের চোখেমুখে ছিল আনন্দের আলো,প্রবাসফেরত প্রিয়জনকে বরণ করতে ছুটে গিয়েছিল ঢাকার এয়ারপোর্টে। প্রিয় মানুষটির ফেরার আনন্দে সেজেছিল সাতটি প্রাণের হৃদয়। সবাই মিলে তুলেছিল একটি ছবিও-গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, প্রাণভরে হাসা সেই ছবি। কেউ জানতো না,সেটাই হবে “শেষ ছবি”।
আর একটু পরেই তারা বাড়ি পৌঁছে যেতেন।কিন্তু নাএকজন ঘুমিয়ে পড়া চালকের অবহেলায়,সেই আনন্দযাত্রাই পরিণত হয় শবযাত্রায়।
৬ আগস্ট, বুধবার ভোর সাড়ে ৫টায়, বেগমগঞ্জ উপজেলার পূর্ব চন্দ্রগঞ্জের জগদীশপুরে মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায় খালে।ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান একই পরিবারের সাতজন-প্রবাস ফেরত বাহার উদ্দিনের মা, স্ত্রী, শিশু মেয়ে, নানী,ভাবি,ভাইয়ের মেয়ে এবং আরও এক আত্মীয়া।এই দৃশ্য শুধু এক পরিবারের কান্না নয়-এই শোক আজ গোটা জাতির।
বাহার উদ্দিনের কান্না শুধু তার নয়-এটা এই রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়
বাহার উদ্দিন আড়াই বছর পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরছিলেন।সামাজিক মাধ্যমে লিখেছিলেন,“স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার…”কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ কফিনে মোড়া,চিরতরে থেমে গেছে রক্তাক্ত খালে।
এই মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়-এটি একটি নৈতিক হত্যাকাণ্ড এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি-যেখানে চালকদের প্রশিক্ষণ নেই,গাড়ির ফিটনেস নেই,যাত্রাপথে বিশ্রামের নিরাপদ সুযোগ নেই এবং সবচেয়ে বড় কথা-চালকের ঘুম আসছে জেনেও থামানোর অনুরোধ বারবার উপেক্ষিত হয়!
প্রশ্ন উঠছেই-এই মৃত্যু থামাতে পারত না কি?
পারতো।যদি চালক সত্যিই দায়বদ্ধ হতেন।যদি পরিবহন মালিক বা সুপারভাইজারদের কোনও মানবিকতা থাকতো।যদি সড়কে পর্যাপ্ত বিশ্রাম কেন্দ্র ও চালক পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকতো।যদি সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের
সচেতনতা কেবল পোস্টারে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবায়ন হতো।বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।তাদের অনেকেই এমন ঘুমন্ত চালকের শিকার।এই মৃত্যু একটা অ্যালার্ম-নতুন নীতিমালার দাবি।
আমরা চাই-
প্রতিটি দূরপাল্লার গাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবে দুইজন চালক থাকুক। চালকের জন্য নির্ধারিত সময় পরপর বিশ্রাম ও ঘুমের ব্যবস্থা থাকুক। প্রতি ৫০ কিলোমিটারে চালকদের জন্য রেস্ট স্টপ ও রিফ্রেশমেন্ট জোন স্থাপন হোক। দুর্ঘটনায় চালকের অবহেলা প্রমাণ হলে জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিচার হোক-শুধু মামলা নয়, দৃষ্টান্তমূলক সাজা।এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক এই ইস্যুতে সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠুক।
এক টুকরো ছবি,এক সাগর কান্না আজ আমরা শোক প্রকাশ করি,কিন্তু শোককে শক্তিতে রূপান্তর না করলে এই মৃত্যু অকারণে যাবে। প্রতিটি বাহার উদ্দিন যেন আর হারিয়ে না ফেলেন তার পুরো পরিবার-সেটিই হতে হবে আমাদের অঙ্গীকার। এই মৃত্যুর দায় শুধু সেই চালকের নয়,এটি গোটা রাষ্ট্র ও সমাজের অবহেলার ফল।আমরা যদি আজই না জাগি,তাহলে পরবর্তী “শেষ ছবি”টা কার,
তা শুধু সময়ের ব্যাপার।
আল্লাহ যেন নিহতদের জান্নাত নসিব করেন।
আর আমাদের সমাজকে দিন-এই নির্মমতা প্রতিরোধের বিবেক।