আমি শাহ-ই-বাঙালি! বাঙালি পরিচয়ের জন্ম-স্মৃতি ও ইতিহাস হত্যার রক্তাক্ত দায়

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।
অনেকেই এই নাম ভুলে গেছেন। কেউ কেউ হয়তো কোনোদিন জানেনই না। কিন্তু এই নাম একদিন ইতিহাসের আকাশে বজ্রনিনাদে ঘোষণা করেছিল:

“আমি শাহ-ই-বাঙালি!”
চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি।
বঙ্গ এক বিভক্ত ভূখণ্ড-সুলতানি যুদ্ধ,ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত আর উন্মেষমান সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে,
একজন মুসলিম শাসক বুক চিতিয়ে বললেন:

“এই বিভক্ত বাংলাকে আমি এক করবো।
এই ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবো।
এই জনগোষ্ঠীকে এক ঐক্যবদ্ধ পরিচয়ে ডাকবো-
বাঙালি।”

ইতিহাসের গর্ভে ‘বাঙালি’ পরিচয়ের জন্ম
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (শাসনকাল: ১৩৪২–১৩৫৮) বাংলা ভূখণ্ডে প্রথম স্বাধীন, একীভূত ‘বাংলা সালতানাত’-এর প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি গৌড়,সোনারগাঁও ও লখনৌতিকে এক করে প্রতিষ্ঠা করেন একটি রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন ও সাংস্কৃতিকভাবে স্বকীয় ‘বাংলা’।
এই ভূখণ্ডে তিনিই প্রথম বলেন:

“আমি শুধু মুসলমানদের নেতা নই।
আমি এই ভাষার, এই মাটির,এই সংস্কৃতির-
আমি বাঙালির শাহ!”

তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু একইসঙ্গে একজন গভীরভাবে ভাষানুরাগী, সংস্কৃতিবান, ইতিহাস-সচেতন রাজনীতিক।
তার নেতৃত্বেই বাংলা ভাষা প্রথমবারের মতো রাজার ভাষা হয়ে ওঠে।
তিনি দিল্লির দাসত্ব ত্যাগ করেন।
আরব-তুর্কি-পারস্যের শাসকদের ছায়া থেকে সরে এসে প্রতিষ্ঠা করেন
“বাঙালি মুসলমান” জাতীয় পরিচয়ের প্রথম ভিত্তি।

আজ যারা বলেন ‘ইসলাম আর বাঙালিত্ব আলাদা’-তারা ইতিহাসহন্তা!

আজ যখন কেউ বলেন-
“ইসলাম তো আর বাঙালিত্বের অংশ না”,
তখন গৌড়ের প্রাচীন রাজপ্রাসাদ হাহাকার করে উঠে।
তখন ইতিহাসের পাতায় আগুন লেগে যায়!

কারণ ইতিহাস অকপটে বলে-
‘বাঙালি’ পরিচয়ের জন্ম হয় মুসলিম শাসকের হাত ধরে,
আর সেই প্রথম ঘোষণাকারী ছিলেন একজন ধর্মবিশ্বাসী মুসলমান -শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।

তাই যারা বলেন,“ধর্মনিরপেক্ষতাই বাঙালিত্ব”,তারা ভুলে যান-
যে সময় ধর্মনিরপেক্ষতার ধোঁয়াশা নেই,
সেই চৌদ্দ শতকেই এক মুসলিম রাজা
“বাঙালি” পরিচয় সৃষ্টি করেছিলেন।

বাঙালি ভাষার অগ্রগতি ও ১৯৩৩ সালের কারেন্সি
একবার তাকান-১৯৩৩ সালের ব্রিটিশ ভারতের এক টাকার নোটের দিকে।
সেখানে বাংলা ভাষা আছে, কিন্তু হিন্দির ছিটেফোঁটাও নেই।
এটাই প্রমাণ-
বাংলা ভাষা তখন ছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ভাষা।
উড়িয়া-টঙ্কা বা হিন্দি নয়- বাংলা-ই ছিল একমাত্র জীবন্ত গণভাষা।

আরো পিছিয়ে যান-
১৯১৩ সালে নোবেল জয় করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলায় সাহিত্য রচনা করে।
বাংলা তখন শুধু ভাষা নয়, ছিল গ্লোবাল লিটারারি পাওয়ার।

১৯০৫, ১৯৪৭, ১৯৭১-
তিনবার বঙ্গভূমি ভাগ হলেও
বাংলা ভাষা ভাগ হয়নি।
ভারত-বাংলাদেশ দুই জায়গাতেই কবিতা লেখা হয়, সিনেমা তৈরি হয়, গান সৃষ্টি হয় – একই ভাষায়।
বাংলা ভাষার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন হাজারো তরুণ।
এই ভাষা একমাত্র ভাষা, যার জন্য রক্ত দিয়েছে মানুষ।

বাংলাদেশী ভাষা বলে কোনো ভাষা নেই।
বাঙালি জাতির ভাষা একটাই -বাংলা ভাষা।
পাঠ্যবইয়ে নেই “Shah-e-Bangali”-ইতিহাস আজ গুম হয়ে গেছে
আজ পাঠ্যবইয়ের পাতায় নেই শাহ-ই-বাঙালির নাম।
নেই বাংলা রাষ্ট্রের ভিত্তির কথা।
নেই মুসলমান শাসকের গর্ব, যারা বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিয়েছেন।
এই বিস্মরণ ইতিহাস হত্যার নামান্তর।
এই গুম ইতিহাসের দায় কেউ না নিলেও আমরা বলবো:

“তোমরা ভুলে গেছো, আমরাই মনে রাখবো।
তোমরা গোপন করেছো, আমরাই উচ্চারণ করবো!”

নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান
ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন জাতি অন্ধ।
যে পরিচয়ে আমরা গর্ব করি-
“আমি বাঙালি”,
তার জন্ম হয়েছিল একজন মুসলিম শাসকের রক্ত, ঘাম, স্বপ্ন আর অভিজ্ঞান দিয়ে।

নতুন প্রজন্মের প্রতি আমাদের আহ্বান-
ইতিহাস পড়ো, চোখ মেলো, সত্য চিনো।
ইতিহাস আমাদের ডাকে
বাংলার ইতিহাস যদি গৌরবময় হয়,
তবে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী ছিলেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।
তার উচ্চারণ ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে:

“আমি শাহ-ই-বাঙালি!”
-শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ

লেখক পরিচিতি:
একজন ইতিহাসপিপাসু,একজন বাঙালি মুসলমান,একজন মাটির সন্তান।