মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বিদায়ের মুহূর্তে চোখ ভিজে আসে, কিন্তু প্রতিটি বিদায় কেবল ব্যক্তিগত নয়-এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের এক গভীর বাস্তবতার আয়না। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ মহিউদ্দিন আজ তাঁর শেষ কর্মদিবস পালন করলেন। আগামী দিনে তিনি কানাডার অটোয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রথম সচিব (পাসপোর্ট ও ভিসা উইং) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সেনবাগের মানুষ তাঁর চলে যাওয়াকে শুধু প্রশাসনিক রুটিন বদলি হিসেবে দেখছে না-এটি তাদের জন্য একজন সৎ, সাহসী ও মানবিক নেতার হারিয়ে যাওয়া।
যেখানে প্রশাসন জনগণের বন্ধু হয়
মোঃ মহিউদ্দিন সেনবাগে যোগ দেওয়ার পর থেকেই প্রমাণ করেছেন-প্রশাসন চাইলে জনতার আস্থা অর্জন করা সম্ভব। দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী কিংবা রাজনৈতিক তদবির-কোনোটিই তাঁকে তাঁর নীতিমালা থেকে সরাতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবের দিনগুলোতে তিনি আহত সাংবাদিক ও আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অবৈধ দখল উচ্ছেদে কোনো গোপন সমঝোতায় যাননি, এবং স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছেন।
সেনবাগের পুরনো খাল সংস্কার, জলাবদ্ধতা নিরসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জনসম্পৃক্ততা, এমনকি “জুলাই যোদ্ধাদের” পাশে থেকে মানবিক সহায়তার মতো কাজগুলো প্রমাণ করেছে-একজন ইউএনও শুধু ফাইল সই করা কর্মকর্তা নন, তিনি চাইলে একজন সামাজিক নেতা হয়ে উঠতে পারেন।
রাষ্ট্রে কেন এমন কর্মকর্তারা বিরল?
এ প্রশ্ন আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। দেশের হাজার হাজার আমলা, কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজনই আছেন যারা সাহস ও সততার সঙ্গে জনগণের জন্য কাজ করেন। কারণ এই রাষ্ট্রযন্ত্র এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে তোষামোদ, রাজনৈতিক লেনদেন ও পদোন্নতির খেলা সবকিছুর ওপর প্রাধান্য পায়। যে কর্মকর্তা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হন, তিনি হয়তো বদলি হয়ে যান-বা বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আমরা কি বুঝতে পারছি না-এই প্রক্রিয়া আসলে জনবান্ধব প্রশাসনের শিকড় কেটে দিচ্ছে?
বিদেশে নতুন দায়িত্ব-সুযোগ নাকি হারানো সম্ভাবনা?
মোঃ মহিউদ্দিন নিঃসন্দেহে তাঁর নতুন দায়িত্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবেন, প্রবাসীদের সেবা উন্নত করবেন। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়-আমাদের গ্রামীণ জনপদগুলো কি আরেকজন এমন কর্মকর্তা পাবে? যে মাঠে নেমে সমস্যার সমাধান করবে, চাপে মাথা নত করবে না, আর জনগণকে আমলাতন্ত্রের করাল গ্রাস থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করবে?
বিপ্লবী প্রশাসনের দাবি
জুলাই আন্দোলনের পর আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি, সেখানে প্রশাসন হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও জনগণের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে একজন ইউএনও বা ডিসি রাজনৈতিক তোষামোদে নয়-জনতার আস্থায় টিকে থাকবে।
আমাদের উচিত, মোঃ মহিউদ্দিনের মতো কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে দেওয়া-যাতে পুরো প্রশাসন জনগণের সেবায় রূপান্তরিত হয়, এবং জনগণ আর মনে না করে যে “ভালো কর্মকর্তা” মানে একদিন হঠাৎ হারিয়ে যাবে।
মোঃ মহিউদ্দিনের বিদায় সেনবাগবাসীর জন্য কেবল শূন্যতা নয়-এটি রাষ্ট্রের জন্যও একটি সতর্কবার্তা: ভালো মানুষ ধরে রাখতে না পারলে, জনতার আস্থা হারাতে সময় লাগবে না।
ইউএনও মোঃ মহিউদ্দিনের সেনবাগে দায়িত্বকালীন উল্লেখযোগ্য কাজসমূহ (তথ্যভিত্তিক তালিকা)
১. বন্যা খাল সংস্কার ও জলাবদ্ধতা নিরসন
দীর্ঘদিন অবহেলিত সেনবাগ পৌর এলাকার পুরনো খাল ও সংযোগ খালের সংস্কার কার্যক্রম শুরু ও সম্পন্ন।
বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা হ্রাসে দৃশ্যমান উন্নতি।
২.“জুলাই যোদ্ধাদের”প্রতি মানবিক সহায়তা
জুলাই ২০২৪ আন্দোলনের সময় ও পরবর্তী সময়ে আহত সাংবাদিক, আন্দোলনকারী ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তা।
সরকারি সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ।
৩.অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান খালের ওপর ও সরকারি জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে দৃঢ় ভূমিকা।
কোনো প্রকার রাজনৈতিক তদবির বা প্রভাবশালী মহলের চাপ মেনে না নেওয়া।
৪.শিক্ষা ও পুরস্কার বিতরণ কর্মসূচি
মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, সনদ ও পুরস্কার প্রদান।
স্থানীয় শিক্ষানুরাগী সমাজসেবকদের সহযোগিতায় শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি।
৫.স্বাস্থ্য ও জরুরি সেবা কার্যক্রম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবার মান উন্নত করতে মনিটরিং ও তদারকি জোরদার।
৬.দুর্যোগ মোকাবিলা ও ত্রাণ বিতরণ
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে দ্রুত ত্রাণ বিতরণ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সমন্বয় ঘটানো।
৭.উন্নয়ন প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ
রাস্তা,সেতু ও অবকাঠামো উন্নয়নে অনিয়ম প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান। কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে সরেজমিন পরিদর্শন।
৮.জনগণের জন্য উন্মুক্ত প্রশাসননিয়মিত“জনসেবা ডে”পালন করে সাধারণ মানুষের সমস্যা শোনা ও সমাধান।
সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থেকে সরাসরি জনগণের সাথে যোগাযোগ।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ