মালয়েশিয়ার সম্মান,বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সম্মানসূচক ডক্টরেটের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
আজ বুধবার,কুয়ালালামপুরের ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া (UKM) বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে।
এই দৃশ্য শুধু একটি শিক্ষাঙ্গনের আনুষ্ঠানিকতা নয়-এটি বাংলাদেশের জন্য এক গভীর প্রতীকী ও কূটনৈতিক মুহূর্ত।

১. আন্তর্জাতিক মঞ্চে নৈতিক নেতৃত্বের স্বীকৃতি
UKM মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তির অন্যতম একাডেমিক স্তম্ভ। তাদের গবেষণা,নীতি-প্রস্তাব ও একাডেমিক মানদণ্ড দেশটির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি পাওয়া মানে শুধু একজন ব্যক্তির সম্মান নয়; বরং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ থেকে নৈতিক নেতৃত্বের একটি প্রতিনিধিত্বের স্বীকৃতি।
অধ্যাপক ইউনূস বহুদিন ধরে “সামাজিক ব্যবসা” ও মানবিক অর্থনীতির মাধ্যমে বিশ্বে বিকল্প উন্নয়ন মডেলের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন। মালয়েশিয়ার মতো এক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, উন্নয়নশীল কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র এই স্বীকৃতির মাধ্যমে তার ভাবনাকে সমর্থন করল।

২.অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য বনাম বহির্বিশ্বের দৃষ্টি
দেশের ভেতরে তিনি দীর্ঘদিন রাজনৈতিক মহলের একাংশের চোখে বিতর্কিত,এমনকি মামলা ও অভিযুক্তির মুখোমুখি হয়েছেন। অথচ বিশ্বের প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয়,গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি তার অবদানকে মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছে।
এই বৈপরীত্য আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির একটি নগ্ন সত্য উন্মোচন করে-আমরা প্রায়ই নিজেদের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের সংকীর্ণ রাজনীতির কাদায় ডুবিয়ে রাখি, আর বিদেশীরা তাদের সম্ভাবনা ও অবদান চিনে নেয়।
এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন তোলে: আমরা কি যোগ্যতাকে রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপরে মূল্যায়ন করতে পারি?

৩.কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব
মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জায়ান্ট। তাদের একাডেমিক ও রাজনৈতিক সমাজের কাছ থেকে স্বীকৃতি মানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, শিক্ষা বিনিময় ও প্রযুক্তি সহযোগিতার নতুন দরজা খোলা।
ইতিহাস বলছে,এমন সম্মান অনেক সময় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘সফট পাওয়ার’বাড়িয়ে দেয়। যেমন-১৯৭০-এর দশকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ থেকে সম্মান পেয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার অবস্থান মজবুত করেছিলেন। কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলা, যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার আগেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একাডেমিক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন-যা তার নীতি-প্রভাব বাড়িয়েছিল।

৪.ইউনূসের‘দ্বৈত মঞ্চ’পরীক্ষা
বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তার কাজ এখন অত্যন্ত কঠিন-যুদ্ধোত্তর ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন,গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফেরানো। একই সাথে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার নেটওয়ার্ক ও স্বীকৃতি বেড়ে চলেছে।
যদি এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে তিনি দক্ষ কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন,তবে বিদেশি বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহায়তা ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের পথ খুলে যেতে পারে। আর তা বাংলাদেশের রূপান্তরযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে।

৫.জুলাই ২০২৪-এর প্রেক্ষাপটে এই স্বীকৃতির কৌশলগত ব্যবহার
জুলাই ২০২৪-এর গণআন্দোলনের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে,তার মূল লক্ষ্য ছিল একটি নতুন, জবাবদিহিমূলক, নাগরিকমুখী রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা। এই পর্যায়ে আন্তর্জাতিক আস্থা ও সমর্থন অপরিহার্য।
UKM-এর এই স্বীকৃতি ঠিক সেই সময়ে এলো,যখন বিশ্ব বাংলাদেশের দিকে নতুন করে তাকাচ্ছে-আমরা কি এই বিপ্লবকে টেকসই করতে পারব?
ইউনূস চাইলে এই সম্মানকে ব্যবহার করতে পারেন তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে-
১.আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক আস্থা তৈরি-বিদেশি বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীদের বোঝানো যে,নতুন বাংলাদেশে নৈতিক নেতৃত্ব ও স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা থাকবে।
২.শিক্ষা ও গবেষণা সহযোগিতা-মালয়েশিয়ার মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে যৌথ বিশ্ববিদ্যালয়,প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্র ও দক্ষতা বিনিময় কর্মসূচি গড়ে তোলা।
৩.আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা-দক্ষিণ এশিয়া ও আসিয়ান অঞ্চলের মধ্যে নতুন বাংলাদেশকে‘সেতুবন্ধন রাষ্ট্র’হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা,যেখানে অর্থনীতি,কূটনীতি ও মানবিক উন্নয়নে আমাদের ভূমিকা থাকবে কেন্দ্রে।

৪.ইতিহাসের শিক্ষা ও আমাদের করণীয়-
বাংলাদেশ অতীতে বহুবার আন্তর্জাতিক সম্মানকে দেশীয় রাজনীতির গণ্ডগোলে নিঃশেষ করেছে। আমরা একসময় জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর সম্মানজনক অভিষেকের সুযোগকে ঘরোয়া রাজনীতির বিষাক্ততায় কলঙ্কিত করেছি;আমরা ড. ইউনূসের নোবেল জয়ের পরেও তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধে লিপ্ত হয়েছি।এবার সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হলে তা শুধু ইউনূস নয়, গোটা জাতির জন্য ক্ষতিকর হবে। কারণ,এমন মুহূর্তগুলোই একটি রাষ্ট্রকে বিশ্বমঞ্চে তার অবস্থান নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ দেয়।

UKM-এর এই সম্মান আমাদের শেখায়-বিশ্বের চোখে নেতৃত্বের মূল্যায়ন হয় তার সততা,দর্শন ও মানবিক অবদানের ওপর, ক্ষমতার কৃত্রিম প্রদর্শনের ওপর নয়।যদি আমরা নিজেদের ভেতরের ঈর্ষা ও সংকীর্ণতা ত্যাগ করে এই অর্জনকে রাষ্ট্রীয় শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারি,তবে এই ডিগ্রি হবে শুধু একজন মানুষের গর্ব নয়,বরং একটি জাতির আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
এবং জুলাই ২০২৪-এর পরিবর্তনের ধারা যদি এই ধরণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়ে পুষ্ট হয়,তবে নতুন বাংলাদেশ কেবল সম্ভাবনা নয়,বাস্তবতায় রূপ নেবে।
লেখক:সম্পাদক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ